এক উপাচার্যের স্মৃতি ও স্বপ্নে জাহাঙ্গীরনগর

বাংলাদেশ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সমবয়সী। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ যেমন নবযাত্রা শুরু করে ১৯৭২ সালে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও তাই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিনজন উপাচার্য ছিলেন ড. মফিজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ড. মুহম্মদ এনামুল হক। ১৯৭৩ সালে এখানকার ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-গবেষক, অনুবাদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আর ১৯৭৬ সালে চার বছরের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য নিযুক্ত হন তিনি। দুই মেয়াদে তিনি এ পদে থাকেন ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার চলার পথে’ (জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০৩)-এর নানা অধ্যায়ে উঠে এসেছে সে সময়কার স্মৃতিচারণ ও এই বিদ্যায়তনকে ঘিরে তাঁর স্বপ্নকল্পনা, যার পাঠ আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারে।

২.

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কলমে জাহাঙ্গীরনগরের বিবর্তমান ভূপ্রাকৃতিক অবস্থার বর্ণনা শোনা যাক:
‘দীঘে বেশি আড়ে কম, এ-রকম সাড়ে সাত শ’ একর জমির ওপর অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়। জমির বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় সবটাই কৃষিকাজের অনুপযোগী, লাল মাটি, সহজেই শ্রীপুর-রাজেন্দ্রপুরের মতো শালবন হতে পারে; এলাকাটি অসমতল তরঙ্গায়িত ও এর মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত অগভীর সর্পিল জলাভূমি। প্রায় বৃক্ষহীন ঊষর প্রান্তর, পরবর্তী বৎসরগুলিতে নিয়মিত বৃক্ষরোপণের ফলে এত দিনে একটি বিস্তৃত উদ্যানের রূপ নিয়েছে। সিকি শতাব্দীর যত্নে-পরিচর্যায় গড়ে উঠেছে এই উদ্যাননগরী, আজকের জাহাঙ্গীরনগর।’

আগের মহাপরিকল্পনায় উপাচার্য ভবনের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট ছিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নিকটবর্তী, জনবসতিহীন স্থানে। তবে অধ্যাপক সিদ্দিকীর চিন্তায় ছিল ঢাকা থেকে দূরে সাভারের এই সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উপাচার্য ভবন হবে মূল আবাসিক এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের যিনি সমাজপতি, তিনি সমাজের মধ্যেই থাকবেন। তাঁর বাসস্থানকে দূরে ঠেলে দিয়ে বা অতিশয় মহিমান্বিত করে, যেন কোনোরূপ ব্যবধান সৃষ্টি না হয় তাঁর সহকর্মীদের। আমার ইচ্ছা ছিল, উপাচার্য ভবন ক্যাম্পাসের সামাজিক জীবনের একটি কেন্দ্রবিন্দু হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনের পাশাপাশি এর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চায়ও বিশ্বাসী ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তাই দেশে সামরিক শাসনের বাতাবরণের মধ্যেও তাঁর কার্যকালে পরপর তিন বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম ‘মুক্তমঞ্চ’, যেখানে বাংলার সেরা নাটকগুলো খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্তভাবে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন শুধু করেনি, প্রতীকীভাবে তা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুক্তচিন্তার সমার্থকতার ধারণাকেও বহন করে। এর নির্মাণ-ভাবনা ও প্রক্রিয়া উদ্ভাসিত হয়েছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর লেখায়:
‘আমার প্রথম আমেরিকা সফরে (১৯৫৮) আমি ডেনভারের রকি পর্বত এলাকায় একটি প্রকৃতিদত্ত মুক্তাঙ্গন দেখেছিলাম। পাহাড়ের উচ্চভূমিতে একখণ্ড সমতল ভূমি, যার তিনদিক ঘিরে পাহাড়ের ঢালু, একদিকে খোলা। সেই পাহাড়ের ঢালুই পরিণত হয়েছে দর্শকের গ্যালারিতে। গ্রীষ্মকালে খোলা আকাশের নিচে এই মুক্তমঞ্চে নাট্যাভিনয় হয়ে থাকে। রকি পর্বতের এই প্রকৃতিদত্ত মুক্তাঙ্গনের থেকেই আমি অনুপ্রেরণা পেলাম, জাহাঙ্গীরনগরের উচ্চাবচ-প্রান্তরে একটি উপযুক্ত ঢালুর খোঁজ পাওয়া। বেশি খুঁজতে হয়নি, যেখানে ক্যাফেটেরিয়া তৈরি হলো, তার কাছেই মিলে গেল আমার প্রার্থিত জায়গা। একজন স্থপতির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম, এই ঢালুকেই আমরা একটি অর্ধবৃত্তাকার গ্যালারির রূপ দিতে পারব। গ্যালারির বিপরীতে থাকবে একটি মুক্তমঞ্চ। কাজটি সম্পন্ন হলো। গ্যালারির ধারণ-ক্ষমতা প্রায় ১ হাজার ৫০০। এর বাইরে অন্তত আরও ৫০০ জন দর্শক দাঁড়িয়ে দেখতে পারবে মঞ্চের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রথম মুক্তমঞ্চ তৈরির কৃতিত্ব অর্জন করল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।’

একজন উপাচার্য প্রশাসনিক দায়িত্বের ভার ও ব্যস্ততার মধ্যেও যে প্রথমত একজন শিক্ষক, সে সত্য বিস্মৃত হননি অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তাই তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন:

‘আমি জাহাঙ্গীরনগরে আমার মূল কাজে মনোনিবেশ করতে পেরেছি। আমি সপ্তাহে দুটি ক্লাস নিয়েছি, ইংরেজি বিভাগে, আমার নিজের মনের তাগিদে। ক্লাস নিতাম আমার অফিসে, কাউন্সিল রুমে, প্রথম পিরিয়ডে। তারপর পাশেই নিজের অফিস-কক্ষে বসে দিনের কাজ শুরু করতাম।’

‘উপাচার্য’ পদ থেকে অবসরগ্রহণ করে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আবার ফিরে গেছেন অধ্যাপনাতে। শান্তিনিকেতনে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ১৯৯০-৯১ মেয়াদে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। তবে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের জাহাঙ্গীরনগর-পর্বকে মনে করেছেন সুবর্ণ অধ্যায়। আজ ১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে প্রয়াত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়।