একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি: সমন্বিত ব্যবস্থাসহ যা করা প্রয়োজন

পালকিতে থাকা মূল্যবান সামগ্রী ঝুড়িতে পুরে তৎক্ষণাৎ পগারপার হলো চোর, শিল্পীর চোখে সেকালের চৌর্যবৃত্তি
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির খবর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রমাণ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির ঘটনা মোকাবিলায় ‘টার্নিটিন’ নামের একটি সফটওয়্যার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ইউজিসির সূত্র থেকে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে দেশের ৩০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সফটওয়্যার সেবা সরবরাহ করা হবে, যার ব্যবহার পর্যায়ক্রমে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চিত করা হবে।

ছবি: সংগৃহীত

এ সফটওয়্যারের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে কোনো একটি গবেষণাকর্ম কিংবা লেখা কত শতাংশ মৌলিক, তা শনাক্ত করে থাকে। অন্যভাবে টেকনিক্যালি বলা যায়, টার্নিটিন মূলত বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ইন্টারনেটে রক্ষিত ডেটাবেইসের বিপরীতে একটি লেখা কতটুকু সাদৃশ্যপূর্ণ, সেটা শনাক্ত করে থাকে এবং তা থেকেই মৌলিকত্ব বিশেষজ্ঞরা নির্ধারণ করে থাকেন।

এখানে বলে রাখা ভালো, টার্নিটিন চৌর্যবৃত্তি শনাক্তকরণের সফটওয়্যার নয়, এটি সাদৃশ্য শনাক্তকরণের একটি সফটওয়্যার। সে জন্য ইন্টারনেটে রক্ষিত ডেটাবেইসের বিপরীতে সাদৃশ্য সূচকের ওপর ভিত্তি করে টার্নিটিন যে ধরনের রিপোর্ট তৈরি করে, তা অবশ্যই একজন বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দ্বারা ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। কারণ, কখনো কখনো টার্নিটিন দ্বারা যাচাইকৃত সাদৃশ্য সূচকের ফলাফল বিষয়ভিত্তিক একাডেমিক টার্ম কিংবা লেখকের নিজের প্রকাশনা উৎসের সঙ্গেও মিলে যেতে পারে।
একাডেমিক জগতে অন্য একজন লেখকের আইডিয়া, লেখা, ফর্মুলা ও গবেষণাকর্ম সেই লেখককে যথাযথ স্বীকৃতি কিংবা উদ্ধৃতি না দিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে চৌর্যবৃত্তি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে পেশাদার অসদাচরণ কিংবা একাডেমিক সততার একটি লঙ্ঘন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে আমাদের নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকে, সেখানে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রতি চৌর্যবৃত্তির মতো নৈতিক অধঃপতনের অভিযোগ দেশবাসীকে আশাহত করা অস্বাভাবিক নয়। এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগামী প্রজন্মকে ভুল বার্তাও দিতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)
ফাইল ছবি

টার্নিটিন সাদৃশ্য সূচক বিবেচনায় একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি রোধে দেরিতে হলেও ইউজিসি যে ভূমিকা নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু একাডেমিক জগতে এ অসদাচরণ প্রতিরোধ করার জন্য দেশের প্রেক্ষাপটে এ সমস্যার আরও গভীরে বিবেচনা করা এবং তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সমন্বিতভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।

শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা যেতে পারে। আমাদের শিশুদের যখন বিদ্যালয় থেকে কোনো কোনো হোমওয়ার্ক, যেমন কোনো অঙ্ক দেওয়া হয়, আমরা অভিভাবকেরাই সাধারণত বাচ্চাদের সেই হোমওয়ার্কের সমাধান নিজেরা করে দিয়ে থাকি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা হোম টিউটর নিয়োগ দিয়ে থাকি, যাঁরা হোম ওয়ার্কগুলো সমাধান করতে সাহায্য করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চারাও সেই সমাধান শতভাগ কপি করে নিজের নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়। জমা দেওয়া হোমওয়ার্কটির কোথাও উল্লেখ থাকে না যে হোমওয়ার্ক সমস্যাটি বাচ্চাদের অভিভাবক দ্বারা সমাধান করা হয়েছে। অভিভাবকের সমাধানকৃত হোমওয়ার্ক বাচ্চারা যথাযথভাবে উদ্ধৃতি না দিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়াই হচ্ছে প্রাইমারি পর্যায়ে একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি। একইভাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নিজেদের অজান্তেই একাডেমিক চৌর্যবৃত্তির চর্চা করবে।

শিক্ষাব্যবস্থার শুরুতেই একাডেমিক এই চৌর্যবৃত্তির সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে আগামী প্রজন্ম নিজেদের চিন্তা বিকশিত করতে ব্যর্থ হবে। সমাজের কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে শনাক্তকরণ ও সীমিত সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে সেই সমস্যার সম্ভাব্য কী কী সমাধান হতে পারে, এই সৃজনশীল চিন্তাচেতনার বিকাশ থেকে আগামী প্রজন্ম বঞ্চিত হবে। ফলে শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

যেহেতু একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনভাবে চর্চা হচ্ছে, সেহেতু আমাদের সমন্বিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেই নিরিখে নিম্নের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে—
*প্রাথমিক পর্যায়ের একজন ছাত্রের ওপর অর্পিত হোমওয়ার্ক অন্য কেউ সমাধান করে দেওয়া কিংবা যথাযথ উদ্ধৃতি না দিয়ে জমা দেওয়া একধরনের অনৈতিক আচরণ। সরকার গণসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে এ অনৈতিক আচরণ সম্পর্কে অবহিত করতে পারে।
*বাজারে বহুল প্রচলিত গাইড বইয়ে লিপিবদ্ধ উত্তর মুখস্থ করে লিখে দেওয়াও একাডেমিক অসততার আরেকটি ভিন্ন রূপ। গণসচেতনতামূলক প্রচারণার পাশাপাশি সরকারকে গাইড বই নিষিদ্ধকরণের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
*প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা করে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি এবং তার মূল্যায়ন–পরবর্তী সঠিক সমাধান কীভাবে দেওয়া যেতে পারে এবং তা কীভাবে জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে কাজে লাগতে পারে, সেই বিষয়ে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্ন কিংবা পরীক্ষাপদ্ধতি চালু থাকলেও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই ওই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষতার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
*সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতির সুফল পেতে হলে আমাদের আরও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি সুচারুভাবে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকর্ষণীয় আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
*বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রজীবনের শুরুতেই একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত করা প্রয়োজন। এখনো তা যদি করা না–ও হয়ে থাকে, বিভাগগুলো একাডেমিক সিলেবাসে কীভাবে অন্যের গবেষণাকর্ম কিংবা লেখা যথাযথ উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে, সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
*একাডেমিক জগতে টার্নিটিনের মতো সফটওয়্যারের মাধ্যমে চৌর্যবৃত্তি শনাক্তকরণ ও মূল্যায়নপদ্ধতি নানা কারণে অনেকের কাছেই ত্রুটিযুক্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই মূল্যায়নপদ্ধতি নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। সে জন্য বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে এ মূল্যায়নপদ্ধতি পরিচালনা প্রয়োজন। অনলাইনের এ যুগে দেশের বাইরের বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদেরও এ মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
*একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি নিরসনে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় সুস্পষ্টভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে।
*সেই আইন সম্পর্কে প্রতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনলাইন ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে নির্মিত এই ট্রেনিং–সংক্রান্ত খরচ খুবই নগণ্য।
*প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘চৌর্যবৃত্তি দমন কমিশন’ নামের একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এই ইউনিটের প্রধানতম কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের গবেষণাকর্মে চৌর্যবৃত্তি সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ এবং চৌর্যবৃত্তি আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।

লেখক: ড. মোহাম্মদ আবদুর রহমান ফরহাদ, শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর