কলেবরে বিশাল, গুণমানে নিচে

বছর বছর নতুন বিভাগ খুলে বড় হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী বেড়েছে, শিক্ষক বেড়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক প্রশাসনিক কর্মী। সব মিলিয়ে কলেবরের দিক দিয়ে বিশাল আকার নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সমস্যা হলো, শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গুণগতমানের দিক দিয়ে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। পড়াশোনা ও গবেষণার মান, উদ্ভাবন, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষার্থীদের আবাসন–সুবিধা, বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পিছিয়ে। এসব কারণে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক অবনতি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে গবেষণাকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের ১ হাজার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। ২০১২ সালেও ৬০১তম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেবরে বড় হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান ও গবেষণার দিক দিয়ে উন্নতি হয়নি। এটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের চিত্রও একই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিসিএসসহ সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করেন। বিভাগের পড়াশোনার দিকে মনোযোগ কম। নতুন বিভাগ খোলার ফলে লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষকদের। তাঁরা পদ পেয়েছেন। দলীয় আনুগত্যের প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে শিক্ষক–রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীদের অবস্থান শক্ত হয়েছে।

শিক্ষার মান, গবেষণা ও উদ্ভাবন নিয়ে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার তেমন কিছু নেই। গর্বের বিষয় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও অতীতের ছাত্ররাজনীতি। বর্তমান উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান অবশ্য গর্ব করার মতো বিষয়ের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর, কম খরচে পড়াশোনা ও শিঙাড়া-সমুচার দামও যুক্ত করছেন। ২ অক্টোবর ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সামান্য টাকায় পড়াশোনার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘ইটস অ্যামেজিং, রেকর্ড।’ আলোচনা সভাটির শিরোনাম ছিল, ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এ আমার অহংকার—এখনই সময় দায়মোচনের’। অনুষ্ঠানে উপাচার্য আরও বলেন, বিদেশি প্রতিনিধিরা এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবরের কথা শুনে অবাক হয়ে যান। তাঁরা বলেন, ‘ইটস আ হিউজ অ্যান্ড ম্যাসিভ ইউনিভার্সিটি।’

এর আগে গত বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়ায় ১০ টাকার প্যাকেজে এক কাপ চা, একটি করে শিঙাড়া, সমুচা ও চপ পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও গর্ব করেন উপাচার্য। বলেন, ‘এটি আমাদের গর্ব, এটি আমাদের ঐতিহ্য।’ যদিও সামান্য টাকায় পড়াশোনা, চা-শিঙাড়ার দাম কম হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকার জোগান দেয় দেশের মানুষ।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি হবে আগামী বছর। শতবর্ষে এসে বিশ্ববিদ্যালয়টি আরও শিক্ষা–গবেষণায় ম্রিয়মাণ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রগতি যতটুকু হওয়ার কথা ছিল, ততটুকু হয়নি—এটা সত্য। গবেষণায় কম বরাদ্দ, ইংরেজি ভাষাগত দুর্বলতা, নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে রাজনীতি ইত্যাদি কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা-পড়াশোনা-গবেষণার সংস্কৃতি উন্নত হয়নি। এসব সমস্যা না থাকলে ‘গ্রাফটা’ আরও তাজা হতো। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা-পড়াশোনার জন্য পরিবেশ নেই, প্রণোদনা নেই, বিনিয়োগ নেই, রাষ্ট্রীয়ভাবে একে নিরুৎসাহিত করা হয়; তবু যে গবেষণা হচ্ছে, তাতে আমি আনন্দ পাই।’

অগ্রগতি যতটুকু হওয়ার কথা ছিল, ততটুকু হয়নি—এটা সত্য। গবেষণায় কম বরাদ্দ, ইংরেজি ভাষাগত দুর্বলতা, নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে রাজনীতি ইত্যাদি কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা-পড়াশোনা-গবেষণার সংস্কৃতি উন্নত হয়নি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে গবেষণাকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের ১ হাজার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। ২০১২ সালেও ৬০১তম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বছর বছর নতুন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি প্রতিবছরই নতুন বিভাগ খোলা হয়। তবে বিভাগ খোলা, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়ানো হয়েছে মূলত বিগত দুই দশকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র অনুযায়ী, ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের সংখ্যা ছিল ৪৭। এখন ৮৪টি। দুই দশকে ৯টি থেকে বেড়ে ইনস্টিটিউট হয়েছে ১২টি। সাড়ে ২২ হাজার থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। শিক্ষক বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

এ ছাড়া দুই দশকে ১৬টি থেকে বেড়ে গবেষণাকেন্দ্র ও ব্যুরো হয়েছে ৫৬টি। প্রশাসনিক কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪১৭। ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স আছে। নিয়মিত শিক্ষার্থীর বাইরে বিভিন্ন কোর্সে সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তাঁদের ক্লাস নেন ৭২৫ জন শিক্ষক। এটা শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের একটি উৎস। তবে অভিযোগ রয়েছে, দিন-রাত ক্লাস নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণায় কম মনোযোগ দেন শিক্ষকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, বিভাগ ও ইনস্টিটিউট সংখ্যার জন্য যে পরিমাণ জায়গা (ফ্লোর স্পেস) প্রয়োজন, তার চেয়ে বর্তমানে কম রয়েছে ১৩ লাখ বর্গফুটের মতো। এ ছাড়া সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশের জন্য পাঠাগার–সুবিধা, আধুনিক গবেষণাগার, আবাসন ও পরিবহনসেবার প্রয়োজন। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে রয়েছে। এ জন্যই শিক্ষার দিক দিয়ে উন্নতি করা যাচ্ছে না। তিনি জানান, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

নতুন নতুন বিভাগ খোলার কারণে কলা ভবনে এখন শ্রেণিকক্ষ পাওয়াই দুষ্কর। সংস্কৃত এবং পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের নিজস্ব কোনো শ্রেণিকক্ষ নেই। এ দুই বিভাগ পালা করে একই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং উর্দু বিভাগেরও শ্রেণিকক্ষ নেই। সংকট রয়েছে প্রায় সব বিভাগেই। বহুসংখ্যক শিক্ষকের নিজস্ব কোনো কক্ষ নেই। অভিযোগ রয়েছে, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন, তাঁরাই নিজস্ব কক্ষ পেতে অগ্রাধিকার পান।

শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের কক্ষের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন জানান, তাঁর বিভাগের জন্য শ্রেণিকক্ষ আছে একটি। আর ২০ জন শিক্ষকের বিপরীতে কক্ষ আছে আটটি। একটি কক্ষ একাধিক শিক্ষক ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, পরীক্ষার খাতা বাসায় নেওয়া যায় না। অথচ খাতা দেখার জন্য শিক্ষকদের কক্ষ থাকে না। এমন নানা সমস্যায় পড়তে হয়।

শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের কক্ষের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন জানান, তাঁর বিভাগের জন্য শ্রেণিকক্ষ আছে একটি। আর ২০ জন শিক্ষকের বিপরীতে কক্ষ আছে আটটি। একটি কক্ষ একাধিক শিক্ষক ব্যবহার করেন।
মো. আখতারুজ্জামান
সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশের জন্য পাঠাগার–সুবিধা, আধুনিক গবেষণাগার, আবাসন ও পরিবহনসেবার প্রয়োজন। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে রয়েছে। এ জন্যই শিক্ষার দিক দিয়ে উন্নতি করা যাচ্ছে না।
মো. আখতারুজ্জামান, উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সমজাতীয় নতুন নতুন বিভাগ

২০১২ ও ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের উদ্যোগে দুটি নতুন বিভাগ খোলা হয়—টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ এবং প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস স্টাডিজ বিভাগ।

টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগটি খোলা হয় ২০১২ সালে। আগে থেকেই সাংবাদিকতা বিভাগে টেলিভিশন, ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ানো হতো, এখনো হয়। নতুন করে বিভাগ খুলে সেখানে চেয়ারম্যান ও শিক্ষক হন সাংবাদিকতা বিভাগেরই শিক্ষক ও একই বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে বিভাগটিতে পূর্ণকালীন শিক্ষক ছয়জন, যাঁদের পাঁচজনই সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।

টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের একটি ব্যাচ ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে, যেখানে শিক্ষার্থী ছিলেন ২৩ জন। এঁদের মধ্যে ১৩ জনের বর্তমান পেশা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, শিক্ষাজীবনের দুই বছর শেষে এখনো পাঁচজন বেকার (সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন), সিনেমাটোগ্রাফার ও ফটোগ্রাফার হয়েছেন তিনজন, দুজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, একজন রাজনীতি করছেন এবং দুজন ব্যবসায়ী। ওই ব্যাচের শিক্ষার্থী সাঈদ শাহজাদা আল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য বিসিএস বা সরকারি চাকরি। এ জন্য পড়াশোনার মনোযোগও সেদিকে।

প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস স্টাডিজ বিভাগটি খোলা হয় ২০১৫ সালে। এর প্রথম চেয়ারম্যান সুধাংশু শেখর রায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে পাঁচজন পূর্ণকালীন শিক্ষকের সবাই সাংবাদিকতা বিভাগ থেকেই পড়াশোনা করা। সাংবাদিকতা বিভাগে পড়া শিক্ষকেরা মুদ্রণ ও প্রকাশনার বিষয়ে কী পড়ান, এ বিভাগটি খোলার প্রয়োজন ছিল কি না, জানতে চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান সুধাংশু শেখর রায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশনার জগৎ, মুদ্রণের জগৎ বিশাল। যেখানে সাময়িকী, বই, দ্রব্যের লেবেল, পোশাকের লেবেল, চিকিৎসাসামগ্রী প্রকাশনার বিষয় আছে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষকেরা বিভাগে যোগ দেওয়ার পর তাঁদের ছয় মাস প্রিন্টিং ও পাবলিকেশন বিষয়ে শেখানো হয়েছে।

সমজাতীয় বিভাগ খোলার উদাহরণ আরও আছে। যেমন একসময় সংস্কৃত ও পালি একটি বিভাগ ছিল। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে পালি আলাদা হয়ে পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ নামে যাত্রা শুরু করে। এ বিভাগে এখন শিক্ষকসংখ্যা ১০। বছরে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হন প্রায় ১০০ জনের মতো। ২০১৫ সালে খোলা হয় যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ (কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস)। বিভাগটির শিক্ষকেরা জানান, কলা অনুষদের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের একটি প্রায়োগিক শাখা চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞান। মানুষের ভাষিক যোগাযোগ সমস্যা দূর করতে দক্ষ স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট গড়ে তুলতে বিভাগটি খোলা হয়েছে।

২০১৬ সালে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে আলাদা করে অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ নামে নতুন বিভাগ খোলা হয়। নতুন এই বিভাগে বছরে ৫৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। শিক্ষক ছয়জন। ২০০৫ সালে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে আলাদা করে খোলা হয়েছে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস নামের একটি বিভাগ। সেখানে শিক্ষকসংখ্যা ২৩। প্রতিবছর ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা নামে একটি বিভাগ রয়েছে। এটি ২০১২ সালে চালু হয়। আবার একই বছর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউট নামে একটি ইনস্টিটিউটও খোলা হয়। ওই বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে প্রতিবছর মোট ৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। শিক্ষক রয়েছেন মোট ২৫ জন।

২০০৭ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আলাদা করে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। সেখানে চালু হয় স্নাতক কোর্স। যদিও দুই বছর আগে বিভাগটি আবার বন্ধ করা হয়। কারণ, অবকাঠামো ও শিক্ষকের অভাব।

২০১৭ সালে জাপানিজ স্টাডিজ নামে একটি বিভাগ খোলা হয়। এতে বছরে প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। শিক্ষক রয়েছেন আটজন। এ ছাড়া ফিন্যান্স বিভাগের পাঠ্যক্রমে থাকা ব্যাংকিং বিষয়টিকে আলাদা করে ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স নামে পৃথক একটি বিভাগ খোলা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগটি ১৯৬৪ সাল থেকে ছিল। ২০০৩ সালে ফার্মাসি বিভাগকে অবলুপ্ত করে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি নামে তিনটি বিভাগ খোলা হয়। ২০১০ সালে ফার্মাসি বিভাগটি আবার চালু হয়। ফলে ওষুধ বিষয়ে বিভাগের সংখ্যা মোট চারটিতে দাঁড়িয়েছে। ফার্মাসি বিভাগে এখন শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ২। অথচ ওষুধসংক্রান্ত অন্য বিভাগে শিক্ষক বেশি। যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে ২৪, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিতে ২৩ ও ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজিতে ২৪ জন শিক্ষক রয়েছেন।

ফার্মাসি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিভাগের (ফার্মাসি) এ অবস্থার জন্য দায়ী শিক্ষক–রাজনীতি। একসময় বিএনপিপন্থী শিক্ষকেরা বিভাগটি ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এখন নীল দলের মধ্যে বিভাজনের কারণে ফার্মাসি বিভাগের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তবে বর্তমান উপাচার্য ফার্মাসি বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন।

গবেষণা মধ্যম মানের

কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে মোটা দাগে ছয়টি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। মোট নম্বর ১০০। একাডেমিক সুনামে ৪০, চাকরির বাজারে সুনামে ১০, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে ২০, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতিতে (সাইটেশনস পার ফ্যাকাল্টি) ২০ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীতে ৫ করে নম্বর থাকে।

কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (এমআইটি)। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে কিউএসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটির গবেষণা ‘আউটপুট’ খুবই উচ্চমানের। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ‘আউটপুটও’ খুবই উচ্চমানের। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটির গবেষণা ‘আউটপুট’ মধ্যম মানের। উল্লেখ্য, এর ওপরে মানের দুটি ধাপ রয়েছে—অতি উচ্চ ও উচ্চ।

বিগত তিন দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর বাড়লেও গুণমানের যে অবনতি হয়েছে, তা স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। তবে র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহে ঘাটতিকে উল্লেখ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী কম কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার কোনো রূপকল্প নেই। যেটা আছে চীন, মালয়েশিয়া ও কোরিয়ার মতো দেশগুলোয়।

দল ভারী হয়েছে নীলের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ১৫টি বিভাগ খোলা হয়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে ৯০০ জনের বেশি শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি–জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম অভিযোগ করেন, নীল দলের শিক্ষকেরা অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খুলে দলকানাদের শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে দল ভারী করার জন্য। বিএনপির আমল নিয়েও একই অভিযোগ থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তখন এত ব্যাপক আকারে হতো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে ১৫টি পদের ১৪টিতে জিতেছে নীল দল। সভাপতি পদে এ এস এম মাকসুদ কামাল পেয়েছেন ৯৩৩ ভোট। আর বিএনপি-জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সাদা দলের প্রার্থী অধ্যাপক লায়লা নূর ইসলাম পান মাকসুদ কামালের অর্ধেকেরও কম ভোট—৪৩৮টি। বেশির ভাগ পদেই বিপুল ভোটে জয়ী হন নীল দলের প্রার্থীরা।

বিগত ১৩ বছরে শুধু ২০০৮ সালে সাদা দলের প্রার্থী সভাপতি পদে জিতেছিলেন। ২০১১ সালে সাদা দল থেকে একজন শিক্ষক সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শিক্ষক সমিতির শেষ তিনটি নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাতে নীল ও সাদা দলের মধ্যে ভোটে বেশ প্রতিযোগিতা হতো। তিনটি (২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫) নির্বাচনেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নীল দল জয়ী হয়। তবে ভোটের ব্যবধান ছিল কম। ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত শিক্ষক সমিতির ভোটে শীর্ষ দুই পদের একটিতে নীল, অন্যটিতে সাদা জয়ী হয়।

নীল দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগটি মোটেও সত্য নয়। ১ বা ২ শতাংশের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হয়ে থাকতে পারে।

ব্যয় মানুষের

আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের আকার প্রায় পৌনে তিন গুণ বেড়ে ৮৭০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ টাকার ৮৬ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুদান, যা মূলত দেশের মানুষের করের টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের ৭০ শতাংশ ব্যয় শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মীদের বেতন, ভাতা ও অবসর–সুবিধায়। সরবরাহ ও সেবা খাতের আওতায় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, আবাসন, পরিবহন ইত্যাদিতে ব্যয় হয় ২৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়। গবেষণায় বরাদ্দ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৪২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। জনগণ দেয় দুই লাখ টাকার কিছু বেশি। মানুষের টাকা খরচ করে ‘কম প্রয়োজনীয় ও সমজাতীয়’ বিভাগ খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বড় অংশের ঝোঁক থাকে সরকারি চাকরিতে। তবে সরকারি চাকরির সুযোগ সীমিত। বেশি কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি খাতে। যদিও শিল্প খাতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ ‘আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেখলেই ধরে নেওয়া হতো, চাকরিপ্রার্থীর জানাবোঝা ভালো। এখন আমরা নিয়োগের সাক্ষাৎকারে দেখছি, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মুখস্থবিদ্যানির্ভর।’

বিশ্বজুড়ে শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান সৃষ্টি ও আদান–প্রদান এবং উন্নত মানের শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে জোর দেয়। মুক্তচিন্তার চর্চা করে। যেমন ১২০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তাদের লক্ষ্য সর্বোচ্চ ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও গবেষণা সাধনা করে সমাজে অবদান রাখা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও প্রকাশনাকে উৎসাহ দেওয়া হয় না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেবরে বড় হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান ও গবেষণার দিক দিয়ে উন্নতি হয়নি। এটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের চিত্রও একই।