জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার আবর্তে অব্যাহত পথচলা

ফাইল ছবি

২০২০ সালের ২০ অক্টোবর করোনাকালে ভিন্ন পরিবেশে পালিত হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্ম স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইনবলে ওই বছরের ২০ অক্টোবর থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। মাত্র ৪৮ জন ছাত্র নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার পর বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬টি বিভাগ, ৬টি অনুষদ ও ২টি ইনস্টিটিউটে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী।

শুরুর সময় থেকেই অন্যান্য নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্নমাত্রার সমস্যা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। কারণ, কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া, ত্রুটিযুক্ত একটি আইন দ্বারা শুধু পূর্বপ্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: আশিকুজ্জামান, অক্টোবর ১৯, ঢাকা

রাতারাতি কলেজের শিক্ষকেরা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যান, তেমনি কলেজের শিক্ষার্থীরা হয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র ১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ব্যবস্থা ছাড়াই চলতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করা ১২টি হলের প্রায় সব কটি হল অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এবং আইনি জটিলতার কারণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসনের ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি।

অবশ্য এবারের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য উদ্বোধন হতে যাচ্ছে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল। তবে এ হলে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিতে হবে। পর্যাপ্ত বই ও আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন গবেষণা–উপযোগী কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি গড়ে তোলার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা এখনো চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যানটিনসেবাও অপ্রতুল। উদ্যোগ সত্ত্বেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য পরিবহনব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। এভাবে বহুমুখী সমস্যার আবর্তে থেকে পথচলা অব্যাহত রেখেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্র আন্দোলনের মুখে ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনঃপুনিক ব্যয় জোগানে সরকার কর্তৃক প্রদেয় অর্থ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং পঞ্চম বছর হতে উক্ত ব্যয়ের শতভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় ও উৎস হতে বহন করা হবে’–সংক্রান্ত ২৭/৪ ধারা বাতিল করা হয়। এ–সংক্রান্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধিত) ২০১২ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া এলাকায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণ, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও অন্য ছোট ছোট কাজের জন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার জোগান দেওয়া হয়েছে। এ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর টেন্ডার ও বাস্তবায়নে যেন কোনো সংঘাত বা দুর্নীতি না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে বিভিন্ন অনুষদে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি হন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গ্রামের গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আবাসনসুবিধা না থাকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে মেসে থাকতে হয়। খুব কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বা পাবলিক বাসে যাতায়াত করতে হয় তাঁদের। করোনাকালে অনেক শিক্ষার্থীকে তাঁদের মেসের ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। অনলাইন শিক্ষা শুরু হওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থী কম্পিউটার/ল্যাপটপ/স্মার্টফোনের অভাবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন না। এসব শিক্ষার্থী এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এসব শিক্ষার্থীর জন্য এগিয়ে আসা প্রয়োজন। যেহেতু শিক্ষার্থীরা সেমিনার লাইব্রেরি ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় বই বা প্রকাশনা ব্যবহার করতে পারছেন না, তাই তাঁদের অনলাইনে প্রয়োজনীয় বই বা প্রকাশনা ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-মেইল আইডি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর সঙ্গে ই-মেইল আইডি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ অনলাইন সংযুক্তির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ দেশ-বিদেশের জার্নাল ও প্রকাশনায় আরও বেশি প্রবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এ বিভাগকে আরও বেশি কাজে লাগানো যেতে পারে।

করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে অনলাইনে কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিয়মিতভাবে অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়াও জরুরি। হল হওয়ার আগপর্যন্ত চলমান আন্তবিভাগ ও অনুষদভিত্তিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার আয়োজন আরও সক্রিয় করা প্রয়োজন। প্রতিটি বিভাগ শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল লেখা সংগ্রহ করে তা নিয়ে বছরে দু–একটি জার্নাল প্রকাশ করতে পারে। এতে একদিকে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত পড়ালেখার পরিবেশ পেয়ে জ্ঞানসাধনায় ব্রত হবেন, সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পাবেন এবং নিজেদের আরও সৃজনশীল করে গড়ে তুলবেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকাংশই তরুণ। কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ শিক্ষকেরই গবেষণার প্রতি প্রবাল আগ্রহ রয়েছে। দেশীয় অর্থে বাইরে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বৈষম্যের শিকার হলেও শতাধিক শিক্ষক নিজ উদ্যোগ স্কলারশিপ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন। এ শিক্ষকেরাসহ সবাই যেন শিক্ষা ও গবেষণাকর্ম অব্যাহত রাখতে আরও উৎসাহিত হন, সে জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ সেমিনার পাঠাগারগুলোকে বই ও জার্নাল দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। দেশ-বিদেশের জার্নাল ও প্রকাশনার আরও অবাধ প্রবেশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি এ–সম্পর্কিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে আর্থিক সহযোগিতা নেওয়ার উপায় বের করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ইতিমধ্যে এমফিল/পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত তরুণ শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে তেমন কোনো বৈষম্য না করার উদ্যোগও প্রশংসনীয়। তবে বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে পাঁচ থেকে ছয় বছর লেগে যায়। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সরকারি চাকরিজীবীরা পিএইচডির জন্য সবেতনে পাঁচ বছর ছুটি বা ডেপুটেশন পেলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেতনে চার বছর ছুটি দেওয়া হয়। এতে বাইরে পিএইচডি করা শিক্ষকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া বিশেষ গবেষণা ভাতা প্রাপ্তি, বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপসহ কিছু বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কিছুটা আর্থিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের মতো শিক্ষকদেরও আবাসনসুবিধা না থাকায় তাঁদের অনেক কষ্ট করতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য নবনির্মিত বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল
ছবি: আশিকুজ্জামান, অক্টোবর ১৯, ঢাকা

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নানাবিধ সমস্যা থেকে উত্তরণে নির্বাচিত শিক্ষক সমিতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী এসব সমস্যা সমাধানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করা, শিক্ষকদের বিভিন্ন অধিকারের কথাগুলো প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা, প্রয়োজনে প্রশাসনের অযৌক্তিক ও নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা, সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দাবিদাওয়া প্রশাসনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নির্বাচিত শিক্ষক সমিতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে শিক্ষক সমিতির কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সময় শিক্ষকদের মধ্যে আন্তবিভেদ ও বিভাজন সৃষ্টি হয়, যা কাম্য নয়। আমাদের সবাইকে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো ব্যক্তিবিশেষ, দলীয় বা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন নয়, বরং শিক্ষকদের অধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করাই এ সমিতির মূল লক্ষ্য।

পরিশেষে বলব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অনেক সমস্যার সমাধান রাতারাতি করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অনেক সমস্যা সমাধানের পথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে নেই। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার ইতিমধ্যেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করেছে, সমস্যা পূরণে আশ্বাস দিয়েছে এবং আশা করি, ভবিষ্যতেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে থাকবে।

শিক্ষার্থীদের কাছেও প্রত্যাশা থাকবে, তাঁরা নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে, ধৈর্য ধারণ করে তাঁদের জ্ঞানচর্চার বিষয়কেই বেগবান করবেন। কারণ, প্রতিকূলতার কাছে হার মানার চেয়ে সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সীমিত সুযোগ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব সমুজ্জ্বল করার মাধ্যমে তাঁদের প্রতি করা বৈষম্য ও বঞ্চনাকে ছাপিয়ে অর্জনকেই বড় করে তুলবেন—এটিই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]