ঢাবি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্‌যাপন, কয়েকটি প্রশ্ন…

আলোকসজ্জ্বায় অপরাজেয় বাংলা। কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১ জুলাই।
ছবি: সাইফুল ইসলাম

এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা ৫০ বছর উদ্‌যাপিত হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হচ্ছে। একটি জাতি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০০ বছর উদ্‌যাপনের ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ ও প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয় অপরিহার্য। সামগ্রিক কল্যাণে ও ভবিষ্যৎ উৎকর্ষের স্বার্থে প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবা খুবই প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ কাল বৃহস্পতিবার। করোনার প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীর কোনো আয়োজন নেই। শিক্ষার্থীদের কারণে মুখর মধুর ক্যানটিন এখন একেবারেই ফাঁকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৩০ জুন।
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আমাদের এ প্রশ্ন তুলতেই হবে, গত ৫০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী অবদান রেখেছে? পাঁচ দশকে প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কয়জন বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক, সমাজকর্মী, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কূটনীতিজ্ঞ কিংবা সাংবাদিক তৈরি করতে পেরেছে? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে ওঠা রাজনীতিবিদ কারা? বৈশ্বিক ব্যবসায় পরিসরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা প্রশংসনীয় নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন? প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসনীয় মুখগুলো কোথায়, যাঁরা বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল নক্ষত্র? প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পালিত হচ্ছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উল্লিখিত প্রশ্নগুলি কি অবান্তর কিংবা অযৌক্তিক? যে বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১২ সালে, ১০০ বছর আগে অবিভক্ত ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যেখানে আন্তর্জাতিক মানের গুণী ব্যক্তিরা শিক্ষকতা করেছেন, প্রশাসনিক নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ নয় কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটানো এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গেছে। এই মুহূর্তে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং দেশের সব উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানগুলোর ভূমিকা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতে বিশেষত আমাদের উন্নয়নের বহুমুখী দিকগুলো বিপুল পরিসরে আলোচিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপন উপলক্ষে দেশের এ প্রাচীন প্রতিষ্ঠান ও উচ্চশিক্ষার অন্য পীঠস্থানগুলোর সার্বিক মূল্যায়ন করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। দেশ ও জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে শিক্ষা খাতের অগ্রগতির বিকল্প নেই। জাতির খুঁটি হিসেবে শিক্ষায় উৎকর্ষ ও নেতৃত্ব দিতে না পারলে ইতিমধ্যে অর্জিত তথাকথিত উন্নয়ন অচিরেই ভেঙে পড়বে।

বর্ণিল আলোকসজ্জার ছবি তুলছেন একজন। কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১ জুলাই।
ছবি: সাইফুল ইসলাম

লক্ষণীয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ব্যাপক উদ্দীপনা চোখে পড়ছে। আমাদের এই উচ্চশিক্ষিত নাগরিক সমাজের চিন্তা-ভাবনা, কর্মযজ্ঞের ওপর নির্ভর করছে বিশ্বের দরবারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মুখ। কিন্তু তাঁরা যদি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও সক্ষমতার সঙ্গে ওপরের প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা না করেন, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন হতে পারে। তা ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী এ দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সম্পন্ন হওয়ার পর রাষ্ট্রে তাঁদের অবস্থান কী, অবদান কী কিংবা রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বা বোঝাপড়া কেমন, এসব প্রশ্ন নিয়ে আমাদের তরুণ সমাজকে ভাবতে হবে।

দেশের একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায়, স্বনামধন্য এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে বেসরকারি খাতগুলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ গ্রাজুয়েট না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে, আরেকটি দৈনিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের এক সাক্ষাৎকারের শিরোনাম এসেছে, ‘What Dhaka University thinks today, others think tomorrow’। শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে সামষ্টিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু উপাচার্য মহোদয় আমাদের প্রত্যাশার ব্যত্যয় ঘটালেন। শিক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিচার করা এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একাডেমিক, রাজনীতি, ব্যবসা, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ, বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন করা এ সময়ের সবচেয়ে জরুরি বিষয় নয় কি?

বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোঝাপড়া হওয়া জরুরি। কিন্ত গত ৫০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে মুক্তচিন্তার চর্চা রাজনৈতিকভাবে ধূলিসাৎ করা হয়েছে। অশ্লীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন করা হয়েছে। ক্যাম্পাসগুলোয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সংস্কৃতি কবর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তি, যাঁরা ওই স্বপ্ন চিন্তা ও মননে লালন করেন, তাঁরাও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি এ কাজে ভূমিকা রেখে গেছেন। এ কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাণহীন ও নির্জীব। এখানে কোনো জ্ঞানের আওয়াজ নেই, কেবল হইহুল্লোড়! যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালে বাইরের উল্লাস ও হইহুল্লোড়ের জন্য শিক্ষক যথাযথভাবে ক্লাস নিতে পারেন না, সেখানে জ্ঞানার্জন বাধাগ্রস্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? এই সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরূপও অস্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা না থাকায় জাতীয় গুরুতর বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারছেন না। ফলে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব প্রশ্ন তোলার কথা ছিল, তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে না। লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষণা দেওয়ায় গণতান্ত্রিক চর্চা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে এবং মুক্তচিন্তার চর্চা উঠে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীনতার পর থেকে তীব্র সংকটের মুখে পড়েছে। কর্মসংস্থান, গবেষণা, উদ্ভাবনসহ সব ক্ষেত্রে হিসাব করলে উচ্চশিক্ষার অবদান অত্যন্ত নাজুক। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের ওপরের প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যথাযথ বোঝাপড়া করে নিতে হবে। তরুণদের প্রশ্ন করা জরুরি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী পেয়েছি এবং দেশকে কী দিতে পারছি। রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের বোঝাপড়া করে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া খুবই প্রয়োজন।

*লেখক: ইফতেখারুল ইসলাম, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; জ্যেষ্ঠ নির্বাহী, গবেষণা ও প্রশাসন বিভাগ, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন