নেদারল্যান্ডসে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশিদের জন্য কিছু মৌলিক তথ্য

Md. Rashedul Alam Rasel

অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নেন নেদারল্যান্ডসের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। কিন্তু ভর্তি প্রক্রিয়াসহ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রায়ই অস্পষ্টতার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে ভাষাগত বিষয়ে (যেমন সব ডকুমেন্টস ইংরেজিতে হয় না বা সহজে পাওয়া যায় না; অথবা ইংরেজি ভাষা যথেষ্ট স্পষ্ট নয়)।

নেদারল্যান্ডসে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাস শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছে।

১. অনেক শিক্ষার্থী নেদারল্যান্ডসে আসার জন্য কাতার এয়ারওয়েজকে পছন্দ করছেন, যদিও এমিরেটস ও টার্কিশ এয়ারওয়েজও আমস্টারডামে আসার জন্য উপযুক্ত। যে এয়ারলাইনসেই হোক না কেন, তারা ঢাকা বিমানবন্দরে নেদারল্যান্ডসে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র পরীক্ষা করবে (এবং অন্যান্য চূড়ান্ত গন্তব্য)।

এর মধ্যে রয়েছে ফ্লাইটে আগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর পরীক্ষা, স্বাস্থ্য ঘোষণার ফরম এবং কোয়ারেন্টিন ঘোষণা ফরম (এর সঙ্গে Letter of Acceptance এবং ছাত্র ভিসার প্রমাণও প্রযোজ্য)। দুটি ঘোষণাপত্র ফরম ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।

২. পিসিআর পরীক্ষার তথ্য প্রায়ই ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যথেষ্ট স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কারণ, সেখানে উল্লেখ আছে যে ‘যদি বোর্ডিংয়ের ২৪ ঘণ্টার বেশি আগে পিসিআর পরীক্ষা করা হয়, তাহলে একজনকে র‍্যাপিড টেস্ট করতে হবে’। এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য যে বর্তমানে দোহা বিমানবন্দরে সেই পরিষেবা প্রদান করা হয় না। আগে দুবাই বিমানবন্দর এ পরিষেবা প্রদান করেছে, কিন্তু এখন সেই পরিষেবা সেই বিমানবন্দরে চালু আছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। এ সমস্যা এড়াতে যেদিন ফ্লাইট সেই দিন সকালে পিসিআর পরীক্ষা করা উচিত হবে, যাতে আপনি একই দিন বেলা দুইটার মধ্যে ফলাফল পেয়ে যান।

৩. আপনি আমস্টারডামে (Schiphol) বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলে, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পিসিআর/র‍্যাপিড টেস্টের ফলাফল পরীক্ষা করতে পারেন (বা না–ও করতে পারেন)। তবে সবকিছু হাতের কাছে রাখা ভালো।

৪. নেদারল্যান্ডসে পৌঁছানোর পর এখানকার জনস্বাস্থ্য পরিষেবা-GGD (উচ্চারণ Ghe Ghe De)-এর মাধ্যমে পিসিআর পরীক্ষা করা হলে এখানে আসার পঞ্চম দিনে কোয়ারেন্টিন থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পারেন। Schiphol বিমানবন্দরে ব্যাগেজ এলাকা থেকে বেরোলে, সেখানেই একটি GGD বুথ রয়েছে। অনুগ্রহ করে সেখান থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন।

যাঁরা আমস্টারডামে আসছেন, তাঁদের জন্য RAI কেন্দ্রটি বেছে নেওয়া ভালো। কারণ, এখানে গাড়ি/উবার এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সহজে পৌঁছানো যায়। অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা চেক করে নেওয়া প্রয়োজন। যদিও ডাচ কর্তৃপক্ষ কোয়ারেন্টিন নিয়ম সম্পর্কে বেশ নির্বিকার বলে মনে হতে পারে, কিন্তু মাঝেমধ্যেই আকস্মিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাই নিয়মগুলো পরিপূর্ণ অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।
৫. Schiphol বিমানবন্দর থেকে আপনার শহরে কীভাবে যাবেন?

* নেদারল্যান্ডসে পাবলিক যানবহন সর্বত্র সহজলভ্য। আপনি বিমানবন্দরেই ট্রেন স্টেশন পাবেন, খুব সহজে। আপনি যদি ট্যাক্সি নেন, অনুগ্রহ করে যাচাই করে একটি সঠিক ট্যাক্সিতে উঠুন, কারণ বাইরে অনেক স্ক্যামার আছে। Schiphol থেকে Amsterdam/Utrecht/The Hague—এই তিন শহরে যাওয়া সবচেয়ে সহজ।

বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে করে এ তিন শহরে যেতে খরচ পড়বে ৭০-৯০ ইউরো। সব ক্যাব ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করে, কিন্তু কিছু নগদ অর্থ (Euro) আপনার কাছে রাখা বাঞ্ছনীয়।

* ট্রেনে ভ্রমণের জন্য টিকিট কাটার ক্ষেত্রে কিছু স্টেশন নগদ টাকা গ্রহণ করে। তবে নেদারল্যান্ডসে আপনার একটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড থাকা প্রয়োজন। কারণ, নেদারল্যান্ডসে কার্যত নগদ লেনদেন সীমিত। ভ্রমণের টিকিটের জন্য সাহায্য করার জন্য এখানে কাস্টমার কেয়ার রয়েছে।

মনে রাখবেন: ট্রেন কোম্পানি (NS) বিভিন্ন শহরের স্থানীয় গণপরিবহন থেকে আলাদা। ট্রেনের টিকিট লোকাল বাস বা ট্রামে চলবে না। আপনি যদি একটি সাধারণ পরিবহন কার্ড (OV Card) (নাম ছাড়া নীল প্লাস্টিকের কার্ড) পান, তাহলে আপনি যেকোনো ধরনের পরিবহনে এটি ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এটাতে টপ-আপ করতে হবে, যেটা কিছুটা ব্যয়বহুল।

* আপনি যখন আবাসিক অনুমতি (Resident Permit) পেয়ে যাবেন, তখন একটি ছাত্র ভ্রমণ কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন। আপনি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাচল করার জন্য ওই পরিবহনের ভেতরে ট্রাভেল কার্ড কিনতে পারেন। কিন্তু তা ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড দিয়েই কিনতে হবে। কেবল কিছু স্টেশনেই নগদ অর্থে ক্রয় করার অপশনসহ মেশিন থাকতে পারে।

৬. নেদারল্যান্ডসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের ছাত্র ভিসা দেওয়া হয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থীদের কাজের ভিসা দেওয়া হয়। এর অর্থ হলো, আপনি যদি ছাত্র ভিসায় নেদারল্যান্ডসে আসেন, তাহলে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক পারমিট কার্ডের জন্য আবেদন করতে হবে। পিএইচডি শিক্ষার্থীদের আবাসিক পারমিট কার্ডের জন্য তাঁদের বিভিন্ন শহর/স্থানে অবস্থিত Expat Centre-এ যেতে হবে।

আপনার ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসে আবাসিক পারমিট কার্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এ কার্ড সব সময় সঙ্গে রাখা উচিত। এটি নেদারল্যান্ডস যাওয়ার দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে যেকোনো সময় নেওয়া যায়। এই কার্ড ছাড়া কেউ ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন না, যেটার সঙ্গে অন্যান্য পরিষেবা (যেমন ছাত্র ভ্রমণ কার্ড ইত্যাদি) সংযুক্ত।
এখানে আপনার BSN বা নাগরিক নম্বরও পাবেন। এটি আপনার আবাসিক পারমিটে প্রদর্শিত নম্বর থেকে আলাদা। সব সময় আপনার BSN হাতের কাছে রাখুন (এটি একটি নোটবুকে লিখে রাখুন বা আপনার ফোনে এটির একটি ফটো সংরক্ষণ করুন)। কারণ, আপনার স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অন্যান্য জিনিসের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজন।

৭. ইউরোপে আসার সময় মার্কিন ডলার সঙ্গে আনবেন না। এখানে বিনিময় হার একটি গুরুতর সীমাবদ্ধতা। যত কঠিনই হোক না কেন, শুধু ইউরো রাখুন। শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বড় মূল্যমানের ইউরো নোট নিয়ে আসেন (যেমন ১০০ বা ২০০ নোট)। দয়া করে তা করবেন না। এখানে সাধারণ দোকানে কেউ ৫০ ইউরোর ওপরের নোট গ্রহণ করেন না। ১০০ ভাংতি করাও কঠিন এবং ২০০ প্রায় অসম্ভব।

৮. আবাসন পাওয়া বেশ কঠিন, বিশেষত আমস্টারডামে। অন্যান্য জায়গায় (হয়তো Utrecht-এ) একটু কঠিন। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন রয়েছে। আবাসন নিশ্চিত করতে একজনকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্বসহকারে অনুরোধ করতে হবে। পিএইচডি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে, যদি তাঁরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অস্থায়ী আবাসন পান, তা যতই অনাকর্ষণীয় মনে হোক না কেন, আপাতত তা গ্রহণ করা উচিত। ভালো বাসস্থান খুঁজে পেতে যথেষ্ট সময় লাগে। যদি না এটি ছাত্র আবাসন হয়, ব্যক্তিগত আবাসন খুঁজে পাওয়া খুবই জটিল এবং ব্যয়বহুল। Dorm-এর একটি ঘর বা প্রাইভেট আবাসন মার্কেটের মাধ্যমে প্রাপ্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট—যা–ই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আপনাকে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে। একবার আপনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে, আপনাকে আপনার ঠিকানা Gemmente (Municipality) অফিসে নিবন্ধন করতে হবে। যদি আপনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পাঁচ–সাত দিনের মধ্যে নিবন্ধন না করেন, তাহলে আপনি জরিমানা পেতে পারেন!

৯. www.funda.nl এবং www.pararius.nl এর মতো ওয়েবসাইট রয়েছে, যেখান থেকে প্রাইভেট হাউজিং মার্কেটের মাধ্যমে আবাসন খোঁজা সম্ভব (এখানে সামাজিক আবাসন স্কিম আছে, কিন্তু যদিও সেটা মাত্র ইইউর নাগরিকদের জন্য)। অনুগ্রহ করে এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন (যাকে Makelaars বলা হয়), নিজে আবাসন ভিজিট করুন এবং নিশ্চিত হন যে এটি কোনো স্ক্যাম নয়। অনেকে এ ধরনের স্ক্যামের শিকার হয়েছেন, বিশেষ করে আমস্টারডামে।

আয়ের উৎস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অনুপস্থিতিতে (শিক্ষার্থীদের জন্য) আপনার স্থানীয় গ্যারান্টারের প্রয়োজন হতে পারে। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গ্যারান্টারের প্রয়োজন হয় না।

১০. আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আপনাকে AON স্টুডেন্ট ইনস্যুরেন্স প্রদান করা হবে, যার জন্য আপনাকে সব চিকিৎসাসেবার জন্য অর্থ প্রদান করতে হবে এবং তারপরে আপনি ব্যয়কৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য দাবি করতে পারেন। AON-কে navigate করা জটিল। যদি এটি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমাকারী হয়, তাহলে আপনাকে প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে বিকল্প বিমার জন্য বলতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের চিকিৎসকেরা শুধু ‘প্যারাসিটামল’ লিখে দেবেন, এমনকি গুরুতর স্বাস্থ্য অবস্থার (emergency) ক্ষেত্রেও। সুতরাং ওভার দ্য কাউন্টার/সাধারণ ব্যবহার্য অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি Ace/Napa Extra, anti-histamine, Scabo এবং অনুরূপ প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে করে নিয়ে আসা ভালো। বিশেষভাবে যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক রোগে ভুগছেন, তাঁদের ওষুধপত্র নিয়ে আসা ভালো।

Md. Rashedul Alam Rasel

১১. যদি আপনি বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি টিকা পান, তার মানে এ নয় যে আপনাকে টিকা পাসপোর্ট দেওয়া হবে। যদিও ডাচ সরকার এখন সেরাম ইনস্টিটিউটের অ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ বিভিন্ন টিকাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তাতেও এটা নিশ্চিত নয় যে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের ‘ভ্যাকসিন ভ্রমণ পাসপোর্ট’ দেবে। আপনি যদি টিকা না পান, অন্তত আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের Roeterseiland ক্যাম্পাসে সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর জন্য টিকাকেন্দ্র থাকবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ পরিষেবা থাকতে পারে (যা আপাত জানা নেই)। যদি আপনি নেদারল্যান্ডসে টিকা পান, আপনি ভ্যাকসিনের পাসপোর্ট পাবেন, যা আপনাকে পিসিআর পরীক্ষার প্রয়োজন ছাড়াই অন্য EU–ভুক্ত Schengen দেশে ভ্রমণের অনুমতি দেবে।

১২. ভ্যাকসিন পাসপোর্ট এবং নেদারল্যান্ডসে অন্যান্য প্রশাসনিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত বিষয়ে DigiD-এ নিবন্ধন করুন। এটি নেদারল্যান্ডসে বসবাসকারী প্রত্যেকের জন্য অনলাইন শনাক্তকরণ পোর্টাল। এটি স্বাস্থ্যসেবা, কর, শিক্ষাগত সমস্যা ইত্যাদির সঙ্গে সংযুক্ত।

একবার আপনি DigiD আইডি পেয়ে গেলে, আপনি টিকা কার্ড অ্যাপটি ডাউনলোড করতে পারেন এবং আপনাকে একটি QR কোড দেওয়া হবে। এটিই মূলত আপনার বিশ্বব্যাপী টিকা কার্ড; এবং গুরুত্বপূর্ণ যদি আপনি ভ্রমণ করতে চান, বিশেষ করে গোটা ইউরোপে।

১৩. পরিশেষে, বিশেষ করে বাংলাদেশি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য, সাইকেল চালানো শিখে আসা সর্বোত্তম। সাইকেল চালানো না জানা নেদারল্যান্ডসে একটি বিশাল সীমাবদ্ধতা। এখানে আপনাকে শেখানোর লোক আছে, কিন্তু দেশে থেকে শিখে আসাই ভালো।

উল্লিখিত বিষয়গুলো একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে নেদারল্যান্ডসে খুব দ্রুত, সহজেই মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়।