বিবাহিত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ বৈষম্যমূলক

দেশের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৭ টিতে এমন কোনো নিয়ম নেই। ভারতের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানা যায়, সেখানেও নেই ওই নিয়ম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকতে পারবেন না—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোর এই নিয়মকে অমানবিক ও বৈষম্যমূলক বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাঁরা বলছেন, এটা শিক্ষায় নারীদের এগিয়ে নেওয়ার বদলে উল্টো বাধা তৈরির চেষ্টা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের এই নিয়ম সামনে আসার পর দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতটিতে ছাত্রী হলে বিবাহিতদের থাকার বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এই সাত বিশ্ববিদ্যালয় হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রথম আলো যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়েছে, তার মধ্যে শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকতে না দেওয়ার নিয়ম আছে বলে মুখে মুখে প্রচলিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, এই নিয়মের কোনো চর্চা কখনো হয়নি, এখনো হচ্ছে না।

প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি ও কলকাতা সংবাদদাতা ভারতের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকার বিষয়ে কী নিয়ম, তা জানতে খোঁজ নেন। সেখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকতে পারবেন না, এমন কোনো নিয়ম সেখানে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং অরুণাচল প্রদেশের রাজীব গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকতে দেওয়া না দেওয়ার বিতর্ক তৈরি হয় চলতি মাসের শুরুতে। ঘটনার সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয়টির শামসুন নাহার হলে একজন ছাত্রীর আসন বা সিট বরাদ্দের আবেদন নিয়ে। আবেদনটি বিবেচনার সময় আবাসিক শিক্ষকেরা জানতে পারেন, তাঁর এক নিকটাত্মীয় এই হলের ছাত্রী। ওই ছাত্রী বিবাহিত। তখন বিবাহিত এই ছাত্রীর সিট বাতিলের প্রসঙ্গ ওঠে। পরে বিষয়টি জানাজানি হয় এবং বিতর্ক তৈরি হয়। ওই শিক্ষার্থীর আসন এখনো রয়েছে।

রাশেদা কে চৌধূরী
নিয়মটি আগেও ছিল। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন আর এই নিয়ম থাকা উচিত নয়।
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

বিবাহিত হওয়ায় সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের এক ছাত্রীর আসন বাতিলের অভিযোগ ওঠে। এরই মধ্যে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেমা খাতুন ভাসানী হলের বিবাহিত আবাসিক ছাত্রীদের আসন ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। অবশ্য এই নোটিশ গত সোমবার স্থগিত করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকেরা বলছেন, বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকতে পারবেন না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়। রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ১৯৫৬ সালে এই হল স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এই নিয়ম চালু হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, নিয়মটির তেমন একটা প্রয়োগ ছিল না। এখন এটি সামনে আসছে। বিভিন্ন হলের ছাত্রী প্রতিনিধিরা বলছেন, এমন নিয়ম থাকাই অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক। এটি চিরতরে বাতিল করতে হবে। তাঁরা এ দাবির বিষয়ে ১৩ ডিসেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের কাছে আবেদন করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১৯৭৪ সালে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন। নিয়মটি আগেও ছিল। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন আর এই নিয়ম থাকা উচিত নয়। শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের আসনসংকট দূর করতে আরও হল নির্মাণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

কীভাবে এল এই নিয়ম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের সংখ্যা মোট ১৮। এর মধ্যে ৫টি ছাত্রীদের জন্য। বিবাহিত ছাত্রীদের বিষয়ে ছাত্রী হলগুলোর আসন বণ্টনসংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ছাত্রী বিবাহিত হলে হল কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে জানাতে হবে। অন্যথায় নিয়মভঙ্গের কারণে আসন বাতিল হবে। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি শিক্ষাবর্ষে (যে শিক্ষাবর্ষে অধ্যয়ন করেন) হলে থাকতে দেওয়া হবে। আর অন্তঃসত্ত্বা হলে থাকতেই পারবেন না।

আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইন বা বিধির অধীনে হয়েছে, তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে দুটি ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ, প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ও একজন সিন্ডিকেট সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা সবাই বলেছেন, নিয়মটি অনেক বছর ধরে চলে আসছে। তবে এটি আইনের কোনো বিষয় নয়। শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লাফিফা জামাল বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীও ছিলেন। তখন থেকেই এই নিয়মের কথা জেনে এসেছেন।

এই নিয়ম যাঁরা বাতিলের পক্ষে, তাঁদের যুক্তি তিনটি: ১. বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকতে পারবেন না, এটি অমানবিক। কারণ, অনেকের পরিবার গ্রামে থাকে। তাঁদের পক্ষে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা না-ও থাকতে পারে। ২. নিয়মটি বৈষম্যমূলক। কারণ, ছাত্রদের হলে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নই করা হয় না। ৩. এটি সুশাসনেরও প্রশ্ন। যেখানে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-নেত্রীরা ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও প্রভাব খাঁটিয়ে হলে থাকেন, সেখানে বিবাহিত ছাত্রীদের বের করে দেওয়া কেন?

কবি সুফিয়া কামাল হল সংসদের সর্বশেষ নির্বাচিত কমিটির (এরপর নির্বাচন হয়নি) সাধারণ সম্পাদক মনিরা শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছি, তখন এ ধরনের নিয়ম থাকতে পারে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আসনসংকটের অজুহাত তুলে কেউ কেউ বিবাহিতদের না থাকতে দেওয়ার পক্ষে। তবে এর পাল্টা হিসেবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক বিভাগ খুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর সময় অবকাঠামো সংকটের বিষয়টি কেন বিবেচনায় নেওয়া হলো না। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ ছিল ৪৭টি। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩টিতে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ হাজার থেকে বেড়ে ৩৭ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এখন ছাত্রীর সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। ছাত্রীদের জন্য হল ও হোস্টেলে (২টি) আসন আছে ৫ হাজার ৭০০টি।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়াদের হল থেকে বের করে দিলে আসনসংকট অনেকটাই কাটবে। নতুন হলও নির্মাণ দরকার। প্রশাসনের ব্যর্থতার ভুক্তভোগী কোনোভাবেই বিবাহিত ছাত্রীদের বানানো যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এই নিয়ম মোটেই থাকা উচিত নয়। এটি যুগোপযোগীও নয়। বৈধ শিক্ষার্থী বিবাহিত হলেও তাঁদের হলে থাকতে দেওয়া উচিত।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়ম নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে পরিষদ বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকার বিষয়ে আরোপিত বিধিনিষেধ পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে।

আট বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নিয়ম

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫১। জাতীয়, উন্মুক্ত ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত কলেজগুলো বাদে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাব অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৩৮ শতাংশ ছাত্রী।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলে বিবাহিত ছাত্রীদের থাকার বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রীদের জন্য ৬টি আবাসিক হল রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের পাঁচটি আবাসিক হলে আসন বরাদ্দসংক্রান্ত নীতিমালায় বিবাহিতদের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই।

আরও পড়ুন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকতে পারবেন না—২০১৯ সালে পাস হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শৃঙ্খলা অধ্যাদেশে এ বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ উল্লেখ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের বিভিন্ন নথিতে দেখা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৬ সালের শৃঙ্খলা বোর্ডসংক্রান্ত অধ্যাদেশে উল্লেখ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে বিবাহিত ছাত্রীরা থাকতে পারবেন না।

সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন আনু মুহাম্মদ, তিনি এখন একই বিভাগের অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকতে না দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর ছিল না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার বিষয়ে বিবাহিত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই বলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন।

আজ বৈঠক

১৩ ডিসেম্বর ছাত্রী হলের প্রতিনিধিরা বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকতে না দেওয়ার নিয়মটি বাতিল চেয়ে যে আবেদন করেছিলেন, তাতে মোট চারটি দাবি জানানো হয়। নিয়মটি বাতিলের বাইরে বাকি তিন দাবি হলো: ১. শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মর্যাদা রক্ষায় হলের নথিতে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ‘স্থানীয় অভিভাবকের’ পরিবর্তে ‘জরুরি যোগাযোগ’ শব্দটি রাখা। ২. হল প্রশাসনের যেকোনো ধরনের হয়রানি রোধে ব্যবস্থা নেওয়া। ৩. অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশের অধিকার পুনর্বহাল করা ও জরুরি প্রয়োজনে তাঁদের হলে অবস্থান করতে দেওয়া।

এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক ডেকেছে। উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকতে না দেওয়ার নিয়মটি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংস্কার ও পরিমার্জন করার প্রয়োজন পড়েছে। এ জন্যই এই সভা।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা]