বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা

ফাইল ছবি

সম্প্রতি ইউএনডিপির বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে। এটি হচ্ছে একটি দেশের সাতটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান জ্ঞানের একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন। আর এ সাত ক্ষেত্র হচ্ছে প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল শিক্ষা ও ট্রেনিং, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, উন্নয়ন এবং আবিষ্কার (ইনোভেশন), তথ্য এবং যোগাযোগপ্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ সৃষ্টি। এ বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক–২০২০–এর ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১২তম। এতে অবাক না হলেও মনটা বেশ খারাপই হলো।
অবাক হইনি এ কারণে যে বাংলাদেশে জ্ঞান সৃষ্টির যে অবকাঠামো অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, বিদ্যমান পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং প্রমোশন সিস্টেম—এর কোনোটাই এই জ্ঞান সৃষ্টির অনুকূলে নয়। আর মন খারাপ হলো এই ভেবে যে এভাবে আর কত দিন? এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি অথচ এই ৫০ বছরে আমরা এখনো এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারিনি, যেটি বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান করবে এবং জ্ঞান সৃষ্টিতে পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে।

হতাশাজনক হলেও এটি সত্য যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ভগ্নদশা নিয়ে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের ওপরের দিকে স্থান পাওয়ার আশা করা বাতুলতা মাত্র।
এ করোনাকালে আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিনের পর দিন বন্ধ ছিল অনলাইন শিক্ষা প্রদানের কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকার কারণে। আফসোস যে আমরা কেবল ফিজিক্যাল অবকাঠামো তৈরি করেছি, কিন্তু ভার্চ্যুয়াল শিক্ষা প্রদানের কোনো সিস্টেম তৈরি করিনি, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একান্ত আবশ্যক। উন্নত বিশ্ব তো বটেই, উন্ননয়নশীল বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন লার্নিং ম্যানেজমেন্ট প্ল্যাটফর্ম থাকে, যার মাধ্যমে শিক্ষকেরা সহজে শিক্ষার্থীদের কাছে কোর্স ম্যাটেরিয়ালস পৌঁছাতে পারেন। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছি, সেখানে ২০২০ সালের মার্চ মাসে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সবাইকে সম্পূর্ণ রূপে অনলাইন ক্লাস চালু করতে হয়েছে করোনার কারণে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বিদ্যমান অনলাইন লার্নিং ম্যানেজমেন্ট প্লাটফর্মের কল্যাণে।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান সৃষ্টির সূতিকাগার। আর এর অন্যতম নির্ধারক হলো একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কী পরিমাণ গবেষণাপত্র বিশ্বের উঁচু সারির জার্নালে প্রকাশিত হয়। কোনো জার্নাল উঁচু সারির কি না, তার নির্ধারক হচ্ছে জার্নালটি স্কিমাগো কিউ ১ র‌্যাঙ্কড কিংবা অস্ট্রেলিয়ান বিসনেস ডিন্স কাউন্সিলের র‌্যাঙ্কিংয়ের এ বা এ স্টার র‌্যাঙ্কড কি না। কিন্তু এ ধরনের উঁচু সারির জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা মোটেও সহজ নয়, এবং এটি সময়সাপেক্ষও বটে। এ জন্য দরকার যথাযথ পরিকল্পনা আর নিরন্তর চেষ্টা। অথচ বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো অর্থবহ ভিশন, মিশন এবং পরিকল্পনা নেই (যদিও শিক্ষকেরা ব্যবস্থাপনার ক্লাসে এগুলোর পাঠদান করে থাকেন!), নেই কোনো এ–সংক্রান্ত প্রণোদনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তাব্যক্তিদেরও গবেষণা ও টপ র‌্যাঙ্কড জার্নাল এ প্রকাশনার বিষয়ে উদাসীন মনে হয়। ডিন কিংবা উপাচার্যদের গবেষণা–সংক্রান্ত কোনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণ করার নির্দেশনা কখনো ছিল কি না, তা আমার জানা নেই।

আমরা যদি কোনো সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো উপাচার্যের মিডিয়ায় দেওয়া বক্তব্য লক্ষ করি তাহলে দেখব, সেখানে মূলত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। কিন্তু গবেষণা বা র‌্যাঙ্কিংয়ের কথা বলা হয় না। তার মানে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক? এবং একজন নতুন উপাচার্যের দায়িত্ব হবে এটা ফিরিয়ে আনা? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সাধারণত লেখা থাকে যে অধ্যাপক অমুককে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব প্রদান করা হলো। কিন্তু একজন উপাচার্যের সফলতা কিংবা ব্যর্থতার সুনির্দিষ্ট কোনো সূচক সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় না। এতে করে সরকারের তোষণ করাই উপাচার্যের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে থাকে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পাঠদান আর গবেষণার মান কীভাবে বাড়ানো যায়, তা প্রাধান্য পায় না।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি অর্থ বরাদ্দের ওপর নির্ভরশীল। এগুলোর আচার্য সাধারণত দেশের সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে থাকেন, তাই উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বনির্ভর এবং এদের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যেমন আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছি, সেখানে সম্প্রতি নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সাধারণ শিক্ষকেরা সবাই ওয়াকিবহাল। উপাচার্য নিয়োগের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলের। আর এই কাউন্সিলের প্রধান হচ্ছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, যিনি সাধারণত একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল আন্তর্জাতিকভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে, আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়ে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জেনে এবং সেখান থেকে যিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা ও গবেষণার মান এবং প্রভাব (পারিপার্শ্বিক, সামাজিক এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রভাবিত করা) সবচেয়ে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবেন, তাঁকেই নিয়োগ দেয়। আবার প্রতিবছর এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কতটুকু হলো তার একটি মূল্যায়ন হয়। এতে করে উপাচার্যরা তাঁদের প্রণীত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কিছু করার চিন্তাও করতে পারেন না।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য হিসেবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অধ্যাপক অমিত চাকমা নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁর নিয়োগও একইভাবে ইউনিভার্সিটি কাউন্সিল কর্তৃক বৈশ্বিক সার্চের মাধ্যমে হয়েছে। আর আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের মূল বিবেচ্য বিষয় কোনটি, তা পাঠকের কাছে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাজার অর্থনীতির এ যুগে আর কতকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোকে বার্ষিক বাজেটের জন্য সরকারের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হবে? সরকার যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোকে ধীরে ধীরে কিয়দংশ হলেও স্বনির্ভর করে তোলে এবং উপাচার্যের কার্যক্রম মূল্যায়নের একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া গড়ে তোলে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব সাধারণ শিক্ষকদের ওপরও পড়বে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়ন
এবার আসুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়নের দিকে আলোকপাত করি। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রত্যেক শিক্ষককে প্রতিবছরের শুরুতে বিগত বছরের কাজের মূল্যায়ন এবং আগামী বছরের পরিকল্পনা বিভাগীয় চেয়ারম্যান বা হেডকে জানাতে হয়। বিভাগের প্রত্যেক শিক্ষকের কাজের মূল্যায়ন এর মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বিভাগের চেয়ারম্যান কীভাবে বিভাগটিকে এক বছরে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে গেলেন, তার একটি মূল্যায়ন করেন অনুষদের ডিন। আর এ মূল্যায়নে প্রধানত তিনটি বিষয়ে জোর প্রদান করা হয়—পাঠদান বা টিচিংয়ের মান ও পদ্ধতি (স্টুডেন্ট ইভ্যালুয়েশনের মাধ্যমে), গবেষণা (টপ লেভেল র‌্যাঙ্কিংয়ের জার্নালে গবেষণাপত্র ছাপানো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ ফান্ড নিয়ে আসা) এবং লিডারশিপ বা কোনো সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করা (যেমন কোর্স কো–অর্ডিনেটর, ডিরেক্টর অব রিসার্চ অব দ্য ডিপার্টমেন্ট)। অথচ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়গুলোর শিক্ষকদের কাজের আনুষ্ঠানিক কোনো মূল্যায়ন কখনো কি হয়েছে? এ ক্ষেত্রে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজের প্রতি দায়বদ্ধ’ এ মর্মে ১৯৭৩–এর অধ্যাদেশটি রক্ষাকবচ হিসেবে কি ব্যবহৃত হয়নি? বছরভিত্তিক কাজের মূল্যায়ন ও পরবর্তী বছরের পরিকল্পনা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য (কেপিআই) ছাড়া কী করে আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধীরে ধীরে উন্নত করতে পারব আর উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিযোগিতা করতে পারব?

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে এখনো একটা সেকেলে ভাব পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বিশেষত বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষকদের গবেষণাসমূহ খুব কমই স্কিমাগো কিউ ১ র‌্যাঙ্কিং জার্নালে বা অস্ট্রেলিয়ান বিজনেস ডিনস কাউন্সিলের র‌্যাঙ্কিংয়ের এ বা এ স্টার র‌্যাঙ্কিং জার্নালে প্রকাশিত হয়।

এ ধরনের টপ লেভেল জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ ছাড়া আমরা কী করে বিশ্বজ্ঞান সূচকে একটা সম্মানজনক স্থান পাব? আনন্দের বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ গবেষক এখন স্কোপাস ইনডেক্সেড জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করছেন, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি কোনো প্রণোদনা ব্যবস্থা প্রদান করা না হয়, তাহলে তাঁরা কীভাবে আস্তে আস্তে টপ র‌্যাঙ্কের জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করবেন? তা ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোর কোনো জার্নালই এখনো ভালো কোনো র‌্যাঙ্কিংয়ে পৌঁছাতে পারেনি। হাতে গোনা কিছু জার্নাল শুধু ‘সি’ র‌্যাঙ্ক অবস্থায় আছে, যেগুলোকে ধীরে ধীরে আরও ভালো র‌্যাঙ্কিংয়ে টেনে তোলার কোনো চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রমোশন সিস্টেমও সেকেলে। এতে কোনো নির্দিষ্ট ও স্বীকৃত জার্নাল র‌্যাঙ্কিংয়ের ব্যবহার সীমিত; বলা আছে শুধু স্কোপাস লিস্টেড জার্নালের কথা কিন্তু সেটা স্কিমাগো ‘কিউ-৩’ বা ‘সি’ র‌্যাঙ্কিং হলেও যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে কীভাবে শিক্ষকেরা ভালো র‌্যাঙ্কড জার্নালে প্রকাশ করার উৎসাহ বা চাপ অনুভব করবেন? অবশ্য এ রকম উদার এবং অস্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। সে জন্য অনেক সময় শিক্ষকনেতারা ইচ্ছা করে এ রকম অস্পষ্ট নীতিমালার ব্যত্যয় চান না। আর তাই এমন ভঙ্গুর উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার যথাযথ পরিবর্তন ছাড়া কীভাবে আমরা বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে একটা সম্মানজনক স্থান আশা করতে পারি?


লেখক: ড. ফজলুল রব্বানী, শিক্ষক, স্কুল অব মার্কেটিং, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, পার্থ, অস্ট্রেলিয়া