মেশিনের শিক্ষা বনাম মানুষের শিক্ষা

মেশিন লার্নিং তথা মেশিনের শিক্ষা বর্তমান যুগে একটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি, যা দিয়ে অনেক জটিল কাজ করা যায়। পৃথিবীর আদি যুগ থেকেই মানুষ মেশিন উন্নয়নের পেছনে অনেক গবেষণা, শ্রম ও সময় দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আজকের বর্তমান যুগে প্রযুক্তির বড় একটা অংশ মেশিনভিত্তিক হয়ে উঠেছে। মেশিনকে আধুনিকায়ন ও স্বয়ংক্রিয় করার জন্য মানুষ এখন অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। আজকের যুগে মেশিন মানুষের অনেক কাজের স্থান দখল করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এর ব্যাপক প্রয়োগ প্রতিযোগিতার সঙ্গে শুরু করেছে। আজকের যুগে মানুষের সময়, মূল্য ও পারিশ্রমিক বিবেচনায় মেশিন এখন আরও বেশি জনপ্রিয়। শুধু তা–ই নয়, একটা মেশিন কাজগুলো নির্ভুল, সঠিক ও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে।

এখন আসি মেশিন কী? মেশিন হলো মানুষের তৈরি যেকোনো যন্ত্র, যা একটি কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে (আধা অথবা সম্পূর্ণ) সম্পাদন করতে পারে। যেমন একটি গাড়ি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। একটি মোবাইল কথাবার্তার আদান–প্রদান করে দিচ্ছে। এখন মোবাইল দিয়ে শুধু কথাবার্তা আদান–প্রদান নয় বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আমরা সম্পাদন করি মোবাইলের মাধ্যমে।

যেমন ইলেকট্রনিক বই পড়া, গান শোনা, ভিডিও দেখা, ছবি সম্পাদনা ও অন্যান্য। এই প্রযুক্তিগুলো কিন্তু হঠাৎ করেই আসেনি। প্রতিনিয়ত গবেষণা, উন্নয়নের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এসেছে ও ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে।

এখন মেশিন লার্নিং সম্পর্কে একটু জানা যাক। মেশিন লার্নিং হলো একটা প্রোগ্রাম বা একটা কাজ মেশিনকে শেখানো। এই কাজটি শেখার পর মেশিন তার মেমোরিতে রেখে দেবে ও পরে সেই কাজটি নির্ভুলভাবে তার শেখানো অনুযায়ী সম্পাদন করবে। ২-১টি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। একটি কুকুরের ডাক শব্দকে মেশিনকে শেখানোর পরে মেশিন তার ডাক শব্দকে মেমোরিতে রেখে দেবে। এখন এই মেশিনকে কয়েকটি ডাক শব্দ শোনানো হলে মেশিন বলে দেবে এটা কোনো প্রাণীর শব্দ। আবার তার ডাক শব্দের সঙ্গে যদি শেখানো হয় এই প্রাণীর কয়টি পা, লেজ কেমন, কান দেখতে কেমন তাহলে মেশিনটিকে কিছু প্রাণীর ছবি দেখানো হলে বলে দিতে পারবে এটা কোন প্রাণী।

আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক, ধরুন, আপনার বাসায় একটি এসি আছে। এখন আপনার রুমের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি, আপনি আজকের তাপমাত্রা অনুযায়ী এসিতে তাপমাত্রা ঠিক করলেন। এরপর দ্বিতীয় দিন তাপমাত্রা অনুযায়ী এসির তাপমাত্রা সেট করলেন। আপনি চিন্তা করলেন এ রকম যদি হতো, এসিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আজকের পরিবেশ অনুযায়ী তাপমাত্রা নির্ধারণ করবে। এখন এসিটিকে যদি এভাবে আগে থেকে শেখানো হয় কোন পরিবেশে কত তাপমাত্রা দিতে হবে, তাহলে কিন্তু এসিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার তাপমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে, যেটা আমরা অটো মেন্যু দিয়ে করে থাকি। এটাকে মেশিন লার্নিংয়ের ভাষায় রিইনফরসমেন্ট লার্নিং বলে, যাকে বলা হয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে প্রতিক্রিয়া করা। মেশিন লার্নিংয়ের ৩টি ভাগ আছে—১. সুপারভাইসড, ২. আন–সুপারভাইসড ও ৩. রিইনফরসমেন্ট লার্নিং। বর্তমান যুগে অনেক বেশি তথ্যভান্ডারের (ছবি, ভিডিও ও লেখা) কারণে মেশিন লার্নিং বেশ জনপ্রিয় এবং এর জনপ্রিয়তা ও শাখা–প্রশাখা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। বিশদভাবে না হয় আরেক দিন লেখা যাবে। এখন মেশিন লার্নিংয়ের সারমর্ম হলো, মেশিনকে শেখানোর পরে সেভাবে প্রতিক্রিয়া বা সম্পাদন করা। সোজা কথায় পূর্বের কর্ম থেকে শিক্ষা নেওয়া। এই মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি কিন্তু মানুষের তৈরি গবেষণার ফল।

মো. আলতাব হোসেন

এখন আসি মানুষের শিক্ষা (হিউম্যান লার্নিং) নিয়ে। এতক্ষণে পাঠকেরা কিছু হলেও অনুমান করতে পারছেন, আমি কী উদ্দেশ্য নিয়ে বলার চেষ্টা করছি। যা–ই হোক, মানুষ জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত শিখতেই থাকে, যার কোনো শেষ নেই। আসলেই কিন্তু শেখার কোনো শেষ নেই। ছোট বেলায় মা-বাবা, ভাইবোন সবার কাছ থেকে শিখেছি। একটু বড় হলে শিক্ষক, সহপাঠীদের কাছ থেকে শিখছি। মসজিদে গিয়ে ইমামদের কাছ থেকে শিখছি। সব জায়গায় কিন্তু একটা বিশেষ জিনিস শেখানো হয় নৈতিকতা, দায়িত্ব, কর্ম ও আচরণ। কেউ কেউ পারলেও কিন্তু আমরা সবাই পারি না শেখানো থেকে সঠিকভাবে সম্পাদন করতে। যার ফলে আজ সমাজে অনেক কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে থাকে। বলা যেতে পারে সবাই কিছু না কিছু ভুল করি। আমরা এখন মেনে নিয়েছি ‘ভুল হবে এটাই স্বাভাবিক’। কিন্তু মানুষের তৈরি মেশিন কিন্তু ভুল করে না। এই বস্তুটি পূর্বের কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে পরে সঠিকভাবে সম্পাদন করে। মেশিন হয়তো জড়বস্তু বলেই শিক্ষাটাকে ভালোভাবে মেনে চলে। সে কোনো অন্যায় আবদার করে না। তাকে যা শেখানো হয়, সে তাই শেখে ও পরে তাই সম্পাদন করে। আর এটাই হলো মেশিন বনাম মানুষের শিক্ষা।

যা–ই হোক, নতুন বছর শুরু হতে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এক বছরে প্রতিষ্ঠানের আয়, ব্যয় ও উন্নয়ন হিসাব প্রকাশ করে। আমাদের ব্যক্তিগতভাবেও কিন্তু এক বছরে বা অতীতে কী করলাম ও এর থেকে করণীয় কী, এটা বছরের শুরুতে নির্ধারণ করা উচিত।

মেশিন লার্নিং প্রযুক্তিকে অনুসরণ করে আপনার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও ভালো ও নির্ভুল করার প্রত্যাশা নিয়ে বছরটি শুরু করুন। অতীতের সমস্যাগুলোকে প্রয়োজনে ছোট ছোট করে ভাগ করুন আর নির্ধারণ করুন আগামীর পথচলা। একবারে হয়তো সব সমাধান হবে না, কিন্তু ২-১টি হলেও সমাধান করার চেষ্টা করুন। আশা করি এভাবে আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে আরও ভালো করতে পারব। যার ফলে একটি শান্তিপ্রিয় সমাজ উপহার দিতে পারব। পরিশেষে সবাইকে ২০২১ সালের জন্য শুভেচ্ছা। আশা করি নতুন বছরে করোনাভাইরাসের অতিমারি দ্রুত শেষ হয়ে আমরা স্বাভাবিক ও কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে আসব।

*লেখক: ড.. মো. আলতাব হোসেন, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ইলেকট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না।