শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: সাফল্য-ব্যর্থতার খণ্ডিত খতিয়ান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনভোকেশন ১৯৩৬ (বাঁ থেকে) স্যার যদুনাথ সরকার (ইতিহাসবিদ), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ঔপন্যাসিক), স্যার জন এন্ডারসন (চ্যান্সেলর ও গভর্নর অব বেঙ্গল), আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রয় (রসায়নবিদ), স্যার এ এফ রহমান (ভাইস চ্যান্সেলর)।
ছবি: সংগৃহীত

বাংলার মুসলিম মানস নিয়ে আহমদ ছফার একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তাঁর মতে, বাংলার মুসলমান যেহেতু বৃহদাংশ নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত, তাই একধরনের হীনম্মন্যতাবশত শ্রেণিগত হিন্দুবিদ্বেষ তাঁদের অনেকটা সহজাত।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের বাঙালি হিন্দু-মুসলিম অসাম্প্রদায়িক সৌভ্রাতৃত্বের যুগান্তকারী দৃষ্টান্তের আগেও বাঙালি মুসলমান বহুবার সে পর্যবেক্ষণ মিথ্যা প্রমাণ করেছে। একাত্তরের আগে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক সহযোগের বড় উদাহরণ দেখা যায় ১৯৫৯ সালের নীল বিদ্রোহে। এই সহযোগ বা সম্প্রীতিটা অনেক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রথমত, এটা প্রমাণ করে যে বাংলার কৃষক বা নিম্নশ্রেণির মানুষ, যাদের অধিকাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের, তারা কখনো সাম্প্রদায়িক-ভাবাপন্ন ছিল না। দ্বিতীয়ত, তত দিনে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থানের লক্ষ্যে এ বাংলাতেই রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে, যার মধ্যে ১৮৫৭ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের Loyal Mohamedans of India-এর প্রতিষ্ঠা, ১৮৬০-এ নওয়াব আবদুল লতিফের ‘কলিকাতা মুসলিম সাহিত্য সভা’ (Mohamedan Literary Society of Calcutta) প্রতিষ্ঠা এবং কিছু পর ১৮৭৭-এ সৈয়দ আমীর আলীর Central National Mohamedan Association. এই শেষেরটি পরে ১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের কাছে মুসলমান প্রজাদের বহুবিধ কষ্টের প্রতিকার চেয়ে এক সুদীর্ঘ লিখিত প্রতিবেদন পেশ করেছিল।

ছবি: সংগৃহীত

এখানে ব্যবহৃত কিছু তথ্য আমি নিয়েছি Bernard— Henri Levy লিখিত Bangla Desh, Nationalisme dans la revolution বইটি থেকে, যা শিশির ভট্টাচার্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কটিই কলকাতায়, মানে বাংলায়। এরা রাতারাতি গজিয়েছে ভাবলে ভুল হবে। বরং এসব মানুষকে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর এ রকম একেকটা সংগঠন দাঁড়িয়েছে। এভাবে উচ্চশ্রেণির মুসলিমদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন-স্পৃহার প্রেক্ষাপটে হিন্দু-মুসলিম কৃষকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ নীল বিদ্রোহ বাঙালি মুসলমানের প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক পরিচয়কেই সামনে নিয়ে আসে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ১৯১২ সালে কলকাতার হিন্দু সমাজের কিছু সদস্য শ্রেণিস্বার্থের খাতিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে নিজেদের সংকীর্ণতার পরিচয় তুলে ধরেছেন। তবে বাঙালির জন্য সুখের যে ওই মানুষদের সংখ্যা বেশি ছিল না। তাহলে গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গলের চূড়ান্ত বিবেচনার জন্য পাঠানো নাথান কমিশনের প্রতিবেদন ১৯১২ সালের শরতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মুসলিম (আহসান উল্লাহ) সদস্যবিশিষ্ট সিনেট কমিটিতে পাস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। বাঙালির জন্য আরেকটা সৌভাগ্যের বিষয় যে শুরুতে সাম্প্রদায়িক রেষারেষির মধ্যে জন্ম হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রকৃত সেক্যুলার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এটি কোনো সাফাই নয়। তবু কলকাতার কিছু হিন্দু নেতৃত্ব কেন বিরোধিতা করেছিলেন, সে বিষয়ে আমার একটা নিজস্ব মূল্যায়ন আছে। তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু তা প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, তা বিশ্বাস করি না। প্রথমত, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সব নেতৃত্ব সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে, তা না-ও হতে পারে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির প্রায় সব ক্রান্তিলগ্নে, অর্থাৎ ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০-এ সঠিক অবস্থানে থাকলেও শিক্ষক ও ছাত্রনেতৃত্ব ’৮৮-তে রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের ভবিষ্যৎ প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করতে পেরে আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, তৎকালীন শিক্ষক পরিষদ রাষ্ট্রধর্ম বিলের নিন্দা জানিয়ে একটি মৌন মিছিল করে এবং ১২ জুন ১৯৮৮-র হরতালে সমর্থন দেয়। ছাত্র সংগঠনগুলো রুটিন বিবৃতির পাশাপাশি ১৬ দল জিপিওর মোড়ে একটি সমাবেশও করে, কিন্তু বৃহৎ দুটি দলের ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা ছিল নগণ্য। তথ্যগুলো ওই সময়ের ‘সংবাদ’ এবং ‘ইত্তেফাক’ থেকে নেওয়া। এটি আশি-নব্বইয়ের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র সম্মিলিত নেতৃত্বের এবং একই সঙ্গে জাতীয় নেতৃত্বের এক ঐতিহাসিক ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করা যায়।

ঠিক একইভাবে কলকাতার হিন্দুরা তাদের এই বিরোধিতার ঐতিহাসিক প্রভাব অনুধাবনে ব্যর্থ ছিল। বঙ্গভঙ্গ এবং অবিলম্বে এর বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষি, অবিশ্বাস এবং সন্দেহ তখন তুঙ্গে। আর পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্রিটিশের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি আপাতদৃষ্টে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে থাকায় তাদের সমর্থন পেলেও হিন্দু নেতৃত্ব বরাবরই ব্রিটিশের বিভক্তির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধতে না দেওয়ার খেলা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। দ্বিতীয়ত, অধস্তন একটি শ্রেণির দ্রুত ক্ষমতায়ন সহজে কেই-বা মেনে নিতে চায়? আর তৃতীয়ত, বাংলাপিডিয়ায় দেখছি ‘Another special feature of the Nathan Committee Scheme was the Department of Islamic Studies in the proposed University of Dacca. This department would render university-level instructions to the students of the reformed Madrasas.’ বস্তুত, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সুয়েজের পূর্ব পারে এশিয়া খণ্ডে প্রথম কোনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষাকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ওপর আগাগোড়া জোর দেওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত সব রিপোর্টে। কলকাতা, চেন্নাই (মাদ্রাজ), মুম্বাই (বোম্বে) বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য কোনো ধর্মশিক্ষার ব্যাপারে তা কখনো দেখা যায়নি। হিন্দুরা এখানে বাড়তি আপত্তির কারণ খুঁজে পায়।

সুতরাং একটি প্রথাগত সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে নিজেদের আঙিনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়-মাপের এক ইসলামি কেন্দ্র নিজেদের ট্যাক্সের টাকায় কেন হিন্দুরা সহজে মেনে নিতে চাইবে? অধ্যাপক ড. শাজাহান মিঞা বাংলাপিডিয়ায় এ বিষয়ে লিখেছেন, Many Hindu leaders were not happy with the government's intention to set up a university at Dhaka. On 16 February 1912, a delegation headed by advocate Dr Rashbehari Ghosh, met the viceroy and expressed the apprehension that the establishment of a separate university at Dhaka would promote 'an internal partition of Bengal'. They also contended, as was recorded in the Calcutta University Commission report later, that 'Muslims of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would benefit in no way by the foundation of a university'. Lord Hardinge assured the delegation that no proposals, which could lead to the internal partition or division of Bengal would meet the support of the government. He also expressed that the new university would be open to all and it would be a teaching and a residential university.

ছবি: লেখক

পরবর্তী সময়ে একটি ইসলামি কেন্দ্রের পরিবর্তে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চয়তা লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছ থেকে পাওয়ার পর এবং সে মর্মে রিপোর্টে কিছু সংশোধনীর ফলে স্বভাবতই হিন্দুদের বিরোধিতা কমে আসে। ১৯২০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে: The University shall be open to all persons of either sex and of whatever race, creed or class, and it shall not be lawful for the University to adopt or impose on any person any test whatsoever of religious belief or profession in order to entitle him to be admitted thereto as a teacher or student, or to hold any office therein, or to graduate thereat, or to enjoy or exercise any privilege thereof, except where such test is specially prescribed by the Statutes, or, in respect of any particular benefaction accepted by the University where such test is made a condition thereof, by any testamentary or other instrument creating such benefaction.
Provided that nothing in this section shall be deemed to prevent religious instruction being given in the manner prescribed by the Ordinances to those not unwilling to receive it by persons ( whether teachers of the University or not ) approved for that purpose by the Executive Council. এর পাশাপাশি ফ্যাকাল্টি-সংক্রান্ত ২২(৫) ধারায় ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতকেও জায়গা দিয়ে ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের প্রসারমাণ সুযোগ রেখে বিশেষ ধারা যুক্ত করা হয়: The Ordinances shall provide for Departments of Oriental Studies (including Departments of Islamic and Sanskritic studies ) in the Faculty of Arts, in which the same degrees shall be conferred as in the other Departments of that Faculty. (সূত্র: The University Of Dacca Act 1920 Vol Xviii: University Of Dacca: Free Download, Borrow, and Streaming: Internet Archive).

এখানে একটা বিষয় অবশ্যই লক্ষ করতে হবে। একধরনের কাদা-ছোড়াছুড়ির মধ্য দিয়ে জন্ম হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালের পরিক্রমায় একটি সর্বার্থে আধুনিক এবং সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে, যেন এক ‘ক্লেদজ কুসুম’ হয়েই বিকশিত। এটি তৎকালীন কলকাতার একশ্রেণির হিন্দু এলিটদের মুখে চপেটাঘাতের শামিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামের বিবর্তনের দিকে তাকালেও দেখা যায় কীভাবে শুরুর ধর্মীয় চিহ্নগুলো ক্রমশ সরিয়ে রেখে সেটি সত্যিকারের সেক্যুলার প্রতীক হয়ে বিরাজ করছে। এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে পশ্চিম বাংলার এলিটদের অন্যায় তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া পূর্ব বাংলার তথাকথিত ‘cultivators’-রাই শেষ অব্দি তাঁদের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। এটি শতাব্দী পরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুখ্য ব্যর্থতার কথাও বলতে হবে। কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গে কৃষির গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করে শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারা কৃষিকে ফ্যাকাল্টি হিসেবে রাখার সুপারিশ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯২০-এ ২২(১) ধারায় তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ আছে। এখানে তা উদ্ধৃত করা হলো: 22 . (1) The University shall include the Faculties of Arts, Science, Law, Medicine and Agriculture, and such other Faculties (whether formed by the sub-division or combination of an existing Faculty or Faculties, or by the creation of a new Faculty or otherwise) as may be prescribed by the Statutes. Each Faculty shall, subject to the con- trol of the Academic Council, have charge of the teaching and the courses of study and the research work in such subjects as may be assigned to such Faculty by the Ordinances. (সূত্র: The University Of Dacca Act 1920 Vol Xviii : University Of Dacca : Free Download, Borrow, and Streaming : Internet Archive).
অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুরু থেকেই বাংলার কৃষকের কৃষিকে একাদিক্রমে অবহেলা করে যাওয়া হয়েছে পূর্ব বাংলার প্রাণস্পন্দন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় কৃষকদরদি বাংলায় আর কেই-বা ছিলেন? এমনকি সেই বঙ্গবন্ধুর ’৭৩-এর অধ্যাদেশেও কৃষিকে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। ‘পূর্ব বাংলার মুসলমানের একটাই কালচার, আর তা হলো অ্যাগ্রিকালচার’—পশ্চিম বাংলার তথাকথিত এলিটদের এই অন্যায় টিটকারিকে অসত্য প্রমাণ করার জন্যই যেন ১৯২০ সালের অধ্যাদেশে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অ্যাগ্রিকালচারকে একেবারে বিদায় দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি তালিকা, এমনকি পাঠ্যতালিকা থেকে। এটি আমাদের এক সূক্ষ্ম হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ নয়তো? শতবর্ষে এর কারণটি খতিয়ে দেখা দরকার।

*লেখক: ইংরেজির অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় কানাডাপ্রবাসী।