শিক্ষার্থীদের জন্য স্টাডি লোন হোক সরকারের নতুন উদ্যোগ

বিদ্যা অর্জনে জ্ঞান বাড়ে, জ্ঞানে আচরণের পরিবর্তন হয়। এখন সেই আচরণ যদি সঠিকভাবে কার্যকরী বা বাস্তবায়ন করা না যায় এবং যদি সেটা মানবকল্যাণে উপকারে না আসে, তাকে আমরা কুশিক্ষা বলতে পারি। সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন এবং আদর্শ গুণাবলিসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি শিক্ষার উদ্দেশ্য।

মূলত, শিক্ষা হলো আত্মজ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি। শুধু ভাষাজ্ঞান, বর্ণজ্ঞান বা বিষয়জ্ঞানের নামও শিক্ষা তবে, সেটা সুশিক্ষা নয়। যে শিক্ষা আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ ও সুনাগরিক হিসেবে গঠন করে এবং পরোপকারী, কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুরাগী হতে সাহায্য করে, সে শিক্ষাই প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা এবং তাকেই বলা হয় সুশিক্ষা। সুশিক্ষা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্তর্দৃষ্টিকে উন্মোচিত করে, দূরদর্শিতা সৃষ্টি করে। এখন এই সুশিক্ষা পেতে, কর্মজীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে এবং তার জন্য গতানুগতিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণে পরিবর্তন আনতে হবে।

সুশিক্ষা অর্জন করতে শিক্ষার পরিকাঠামোকে মজবুত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের ঋণ দেওয়ার সুযোগ করা যেতে পারে, যা পাশ্চাত্যে স্টাডি লোন নামে পরিচিত। শিক্ষার শুরুটা শুরু হোক দায়ভার নিয়ে। দায়ভার কী? দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করাকে দায়ভার বলা যেতে পারে। জ্ঞানের আরেক নাম সচেতনতা। সচেতনতা অর্জন করতে বর্জন করতে হবে অসচেতনতাকে। অসচেতনতাকে বর্জন করতে হলে প্রশিক্ষণের শুরুতে কিছু নর্মস অ্যান্ড ভ্যালুজ থাকতে হবে।

দেশে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে দেখে ভালো লেগেছে। এখন দরকার প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষার ধরন পাল্টানো, যাতে দেশে ভালো, সৃজনশীল এবং সুশিক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়। কারণ, শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যা বিক্রি করতে না পারলে হতাশা এবং গুদামজাত হবে। পরে তা অকেজো হয়ে সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করবে।

পাশ্চাত্যে শিশুর জন্মের শুরুতে তাদের পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুন্দর পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে সুশিক্ষার ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে একটি মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এই ভাতার কিছু অংশ অনুদান হিসেবে এবং বাকি অংশ ধার হিসেবে দেওয়া হয় খুব কম সুদে। শিক্ষাজীবন শেষে যখন তারা কর্মজীবন শুরু করে, তখন ধারের অংশ আস্তে আস্তে পরিশোধ করে থাকে।

পাশ্চাত্যের শিক্ষা মডেলকে বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রশিক্ষণের কিছুটা রদবদল করতে পারলে দেশের শিক্ষার মান বাড়বে বই কমবে না। সে ক্ষেত্রে যারা অষ্টম শ্রেণি শেষ করে পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে কর্মে জড়িত হতে চায়, তাদের সেভাবে সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে, যেমন কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সুইডেনের স্কুলে যেমন নবম শ্রেণি অবধি শিক্ষার্থীদের সবকিছুই ফ্রি। দশম শ্রেণি থেকে তাদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়, যার এক-তৃতীয়াংশ অনুদান, বাকিটা ধার হিসেবে। প্রতি টার্মে শিক্ষার্থীদের তাদের সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করতে হয়। যদি কোনো শিক্ষার্থী তার শিক্ষার ফলাফল আশানুরূপ পর্যায়ে উন্নীত করতে ব্যর্থ হয়, তখন এর কারণ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। এই কারণ দর্শানো যদি কর্তৃপক্ষের মনঃপূত না হয়, তখন তাদের মাসিক ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো তারা যেন লেখাপড়ায় অধিক মনোযোগী হয়।

শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ধরন তৈরি করে নাগরিকের হাতে দেশের দায়ভার তুলে দেওয়া হতে পারে সাফল্যের এক চমৎকার পরিকল্পনা। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের সাফল্য মানেই দেশের সাফল্য। একটি সচেতন জাতির নৈতিক মূল্যবোধের উন্নতি এভাবেই হয়ে থাকে।

সুইডেনের শিক্ষা প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের সরকার ধার দেয়, যার ফলে এরা মা–বাবার ঘাড়ে চেপে বসে থাকে না। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে চাঁদাবাজি, ধান্দাবাজি বা অসৎ কাজকর্ম থেকে তারা বিরত থাকে। ফলে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে। কর্মের শুরুতেই এরা সরকার থেকে যে ধার নিয়েছিল, তা মাসে মাসে ফেরত দিতে শুরু করে। এ ধার শোধ দেওয়ার সময়সীমা কর্মজীবনের ব্যাপ্তি, অর্থাৎ ৬৫ বছর অবধি। ৬৫ বছর কর্মের পর এরা অবসরজীবনে চলে যায় এবং সিনিয়র নাগরিক হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।

সুইডেনের শিক্ষা প্রশিক্ষণের মতো সুযোগ-সুবিধা যদি বাংলাদেশে চালু করা যায়, তবে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের শুরুতেই খুঁজে পাবে এর গুরুত্ব, যা তাদের মোটিভেট করবে এবং জানার জন্য শিখবে বলে আমি মনে করি। প্রশিক্ষণের ধরন পাল্টানো মানে শুধু শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন বা নকল নিয়ন্ত্রণ করা নয়; অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাসহ মনিটরিং পদ্ধতি চালু করাও আশু প্রয়োজন। সরকার বেশ উঠেপড়ে লেগেছে শিক্ষার পরিবর্তনে, কিন্তু যদি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়, সে ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, পরিবর্তনের পিছে যদি যুক্তিসম্পন্ন প্ল্যান না থাকে, তবে সৃজনশীল বা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই দরকার একটি ভালো লং রেঞ্জ প্ল্যান তৈরি করা দেশের প্রশিক্ষণের পুরো পরিকাঠামোর ওপর। হুমকির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ওপর নজর দেওয়া দরকার।

সব শিক্ষার্থীকে স্টাডি লোন দেওয়া এবং জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করা হোক সরকারের নতুন উদ্যোগ। শুধু বর্তমানে কেমন চলছে, তা দেখলে হবে না। আগামী ১০ বছর পর কেমন চলবে, সে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। আজ–আগামীকাল হবে গতকাল, এ কথা মনে রেখে দেশের শিক্ষা প্রশিক্ষণ পরিকাঠামোর ওপর কাজ করা দরকার। সৃজনশীল শিক্ষা পেতে এবং শিক্ষা প্রশিক্ষণের মান উন্নত করতে প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করা আশু প্রয়োজন।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন