সব শিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক

ছবি: প্রথম আলো

পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিক্ষক হওয়ার জন্য ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। তিনি যে পর্যায়ের, যে বিষয়ের শিক্ষকই হতে চান না কেন, তাঁর নিজস্ব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি থাকতেই হবে। অর্থাৎ পাঠদানের বৈজ্ঞানিক কৌশল না জেনে কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে যেকেউ যেকোনো সময় শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন! শিক্ষক হওয়ার জন্য শিক্ষকতা শিক্ষা করার অর্থাৎ শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও পাঠদানের আধুনিক কলাকৌশল আয়ত্ত করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই! এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ তাঁর কাঙ্ক্ষিত অন্যান্য পেশায় যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে শিক্ষকতায় আসেন/এসেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে শিক্ষকতায় আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম থাকা এর অন্যতম কারণ। নিজেই নিজেকে ব্যর্থ মনে করে অনিচ্ছায় শিক্ষকতায় আশা ও থাকা একজন মানুষ মনেপ্রাণে শিক্ষক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। এর মধ্যে যিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা লাভ করে শিক্ষক হয়ে ওঠেন তিনি বা তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি নন।

যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, উন্নত সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক, শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন কাজ বিশেষ করে দেশে যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেননি, আসছেন না যুগ যুগ ধরে। টাকা হলে রাতারাতি শিক্ষা উপকরণ বদল করা যায়, পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যায়, কিন্তু শিক্ষকদের বদল বা মান বৃদ্ধি করা যায় না।

শিক্ষকের মান বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বেতন সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সব শিক্ষকের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে, এমনটি অবাস্তব। কেননা, এ আমি যত দিন আছি, তত দিন দিয়েই যাব ফাঁকি, রেখেই যাব কম দক্ষতার স্বাক্ষর। ছোটবেলা থেকে এমন বলেই তো আমি হতে পারেনি ভালো ছাত্র, যেতে পারিনি অন্য কোথাও। তথাপি বৃদ্ধি করতে হবে আমার তথা শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। প্রশিক্ষিতদের দিতে হবে আরও বর্ধিত বেতন। শিক্ষকতায় আনতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্যদের। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানেরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই উন্নীত হবে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মান। সেটি যতই সময়সাপেক্ষ হোক, এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না কোনো অজুহাতেই। ব্যাপক প্রশিক্ষণ দিয়ে যথাসম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে আমার মতো বিদ্যমান শিক্ষকদের মান। যতটুকু সম্ভব প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানে। এর কোনো বিকল্প নেই বর্তমান বাস্তবতায়।

গ্রামে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। পূর্ব থানাপাড়া, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি, ২৪ মে
ছবি: পলাশ বড়ুয়া

দেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ ও সুবিধা দুটোই অত্যন্ত সীমিত। এ কারণে এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখসহ বিপুলসংখ্যক প্রাইভেট ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকই রয়েছেন প্রশিক্ষণের বাইরে। কেননা, নিয়মিত শিক্ষকতার পাশাপাশি বিএড/এমএড কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ অবারিত নয়। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকায় শিক্ষা ছুটি দিতে চান না প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে বঞ্চিত হয় বিধায় কর্তৃপক্ষ অনীহা দেখিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ছুটি না নিয়ে কর্মরত শিক্ষকদের বিএড ও এমএড কোর্স করার সুযোগ থাকা আবশ্যক।

বর্তমানে শিক্ষকদের বিএড ও এমএড কোর্স করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় এবং ইউজিসির অধীন কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যবস্থা বিদ্যমান সেখানে ইভিনিং কোর্স করার কোনো অনুমোদিত সুযোগ নেই। অথচ এমন সুযোগ থাকা খুব বেশি প্রয়োজন। যেমন: আইনজীবীদের জন্য অনুমোদিত নাইট কলেজ ছিল। কর্মরত শিক্ষকেরা, বিশেষ করে অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য না পাচ্ছেন ছুটি, না পাচ্ছেন ইভিনিং কোর্স করার সুযোগ। এ কারণে তাঁরা নিতে পারছেন না শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। টিটি কলেজগুলো পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত প্রশিক্ষণার্থী। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সক্রিয় বিবেচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে সংশোধন বা পরিবর্তন বা প্রবর্তন করা উচিত ইভিনিং কোর্স চালুসংক্রান্ত বিধি-বিধান।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নেওয়া উচিত ব্যাপক পরিকল্পনা। শুধু বেসরকারি বা প্রাইভেট নয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও রয়েছেন বিপুলসংখ্যক কম যোগ্য, কম দক্ষ শিক্ষক! শিশুদের পাঠদান অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। শিশু-মনোবিজ্ঞানসম্পর্কিত জ্ঞান ও আধুনিক পাঠদান কৌশল আয়ত্ত না করে শিশুদের পাঠদান প্রায় অসম্ভব। শুধু সরকারি সাড়ে চার লাখ শিক্ষকের জন্য নয়, বিপুলসংখ্যক বেসরকারি/প্রাইভেট স্কুল এবং মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্যও থাকা উচিত প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ ও বাধ্যবাধকতা। কেননা, তাঁরাও পাঠদান করেন আমাদের সন্তানদের।

শিক্ষকদেরও জানতে হয় টিচিং মেথড

অন্যদিকে আমরা ভুলেই বসে আছি যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদেরও জানতে হয় টিচিং মেথড। শুধু নিজের পঠিত বিষয়ে ভালো ফল করলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। জানা এবং জানানোর মধ্যে অনেক তফাত। উন্নত অনেক দেশে পাঠদানের যোগ্যতা ব্যতীত পিএইচডি ডিগ্রি থাকলেও কোনো পর্যায়েরই শিক্ষক হওয়া যায় না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া তো আরও অনেক দূরের কথা। শিক্ষক হতে হলে বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রির পাশাপাশি ব্যাচেলর ইন টিচিং বা অনুরূপ ডিগ্রি থাকতে হয়। আমাদেরও ভাবতে হবে তেমনভাবে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে তাদের বিদ্যমান ও অনাগত শিক্ষকদের আধুনিক টিচিং মেথড তথা পাঠদানের কলাকৌশলভিত্তিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে।

সব পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক বিদ্যমান ও অনাগত শিক্ষকের পুনঃ পুনঃ প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য ৫৪টি পিটিআই এবং ১৪টি সরকারি ও ৭১টি বেসরকারি টিটি কলেজ যথেষ্ট নয়। বর্তমানে শুধু মাধ্যমিক স্তরেই প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের সংখ্যা দুই লক্ষাধিক! একজন শিক্ষক একবার প্রশিক্ষণ নিয়ে সারা জীবন শিক্ষকতা করবেন, এমনটি হওয়া উচিত নয়। পুরোনো প্রশিক্ষণ নবায়ন করার জন্য, অধিক উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করার জন্য, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করার জন্য, উৎসাহিত উজ্জীবিত করে কর্মোদ্যম বৃদ্ধি করার জন্য প্রতি পাঁচ বছর পরপর দেওয়া উচিত আপডেট প্রশিক্ষণ। অনন্তকাল চলমান এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পাঠদান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় থাকতে হবে সর্বস্তরের শিক্ষক তৈরির জন্য যথা–উপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদানের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। শিক্ষকদের বারবার প্রশিক্ষণে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে প্রাপ্য ক্লাস থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য রাখতে হবে ইভিনিং কোর্স করার সুযোগ।

অবশ্যই শিথিল করতে হবে টিচিং প্রশিক্ষণে ভর্তির নিয়মকানুন। বিশেষ করে বিদ্যমান শিক্ষকদের সবাইকেই দিতে হবে ভর্তিতে অগ্রাধিকার। মনে রাখতে হবে, বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ খুব বেশি প্রয়োজন, যা অবশ্যই হতে হবে বাধ্যতামূলক। যে শিক্ষকের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো নেই, তাঁর জন্য প্রশিক্ষণ আরও বেশি প্রয়োজন। সব শিক্ষকের জন্য টিচিং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে, বিদ্যমান শিক্ষকদের জন্য ভর্তির নিয়ম শিথিল করে, অনাগত শিক্ষকদের জন্য হাইকোয়ালিটি এনশিওর করে, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইভিনিং কোর্স চালু করে দিলেই প্রয়োজন হবে আরও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের।

নিয়োগপত্র পেলেই শিক্ষক হওয়া যায় না; শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়। শিক্ষক হয়ে ওঠার জন্য অন্যান্য অনেক যোগ্যতা ও গুণের পাশাপাশি অত্যাধুনিক পাঠদানের কলাকৌশল শিক্ষা (ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি) অত্যাবশ্যক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর নাম হওয়া উচিত ‘টিচিং কলেজ’। [Teaching colleges provide classes to help prepare people to teach at various levels. These may include elementary, middle and secondary school levels, as well as higher education, special education, adult education, vocational education etc.]

ভবিষ্যতে অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদেরও এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হতে হবে যে যাঁরা শিক্ষকতায় আসবেন, তাঁরা আগেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে আসবেন। প্রশিক্ষণবিহীন কেউ শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে আমাদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের মান। কেননা, মানবসন্তানকে মানুষ করার কঠিনতম কর্মটি হচ্ছে শিক্ষকের। শিক্ষক যত সুযোগ্য হবেন, আদর্শ হবেন, উত্তম হবেন, শিক্ষার্থী তথা সর্বস্তরের নাগরিক তত যোগ্য হবেন, আদর্শ হবেন, উত্তম হবেন।

*লেখক: মো. রহমত উল্লাহ, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।