স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন: স্বপ্ন যেখানে বাস্তব

২০০৯ সালে স্বপ্ননগর নিয়মিত স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন কিছু তরুণের একটি অভাবনীয় স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের আর দশটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পুরোপুরি আলাদা। ২০০৪ সালে অনিয়মিত যাত্রা শুরু করে অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে বিদ্যায়লয়টি আজকের অবস্থানে এসেছে। এখন মোটামুটি সারা বিশ্বের বাংলাদেশিদের কাছে স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন নামটি সুপরিচিত, কিন্তু শুরু থেকেই উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। ২০০৯ সালে স্বপ্ননগর নিয়মিত স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন গড়ে উঠেছে পাহাড়ের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত চা-পল্লিতে। যেখানে পড়াশোনার কথা ভাবাই যায় না, সেখানে স্বপ্ননগরের উদ্যোক্তারা বিদ্যা ছড়িয়ে দেওয়ার স্বাপ্নিক কাজটা করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।  

স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন কিছু তরুণের একটি অভাবনীয় স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ননগর গত বছরের কার্যক্রমের ভিত্তিতে ১০টি মাইলফলক চিহ্নিত করেছে। নির্ভয় আনন্দময় স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু হিসেবে পাঠদান করেন এবং এখানকার সব শিক্ষার্থী সব ধরনের মানসিক এবং শারীরিক শাস্তি থেকে মুক্ত। সক্রিয় শিখন পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠদানের সব বিষয় শ্রেণিকক্ষেই তৈরি করে দেওয়া হয়, ফলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর কোনো বাড়তি চাপ পড়ে না। শিক্ষাপুষ্টির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা হয়। জীবনগড়া হাইস্কুল বৃত্তির মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, কারণ স্বপ্ননগরে সবাই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারে। হাইস্কুল বৃত্তি প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যেই ২০১৮ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্বপ্ননগরের দুজন ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ হয়েছেন।

জীবনগড়া হাইস্কুল বৃত্তির মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ননগরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষার স্বপ্নবীজ বোনার কঠিন কাজটা করে যাচ্ছেন স্বপ্ননগরের প্রশিক্ষিত শিক্ষকেরা। ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের আগ্রহজাগানিয়া, বন্ধুসুলভ, নিরাপদ ব্যক্তিত্বে পরিণত করা হয়। বর্তমানে স্বপ্ননগরে ১১ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। শহরগুলোর বাইরে থিয়েটারচর্চা যখন বিরল হয়ে উঠেছে, স্বপ্ননগরে শিশুরা তখন গড়ে তুলেছে নিজেদের থিয়েটার। সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতা–কাহিনী’, ‘জুতা আবিষ্কার’ এখন পর্যন্ত স্বপ্ননগরের শিশুদের স্থায়ীভাবে ও চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশিত উল্লেখযোগ্য পরিবেশনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী স্বপ্ননগরের থিয়েটারচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। নাটকসহ শিশুদের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে সুবিধা দিতে ২০১৭-১৮তে নির্মিত নতুন ভবনে একটি অভ্যন্তরীণ ও একটি উন্মুক্ত মঞ্চ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

পাঠদানকে আনন্দদায়ক করার জন্য স্বপ্ননগরের শিশুদের জন্য পাঠাগার ও নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

পাঠদানকে আনন্দদায়ক করার জন্য স্বপ্ননগরের শিশুদের জন্য পাঠাগার ও নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। শিশুরা সপ্তাহে পাঁচ দিনই প্রতিদিন একটা ক্লাসে নাচ, গান, নিজেদের গল্প-ছড়া লেখালেখি, বিতর্ক, আঁকাআঁকি এমন সুকুমার চর্চা করছে। এ ছাড়া প্রতিদিন সকালে স্কুলে এসেই স্বপ্ননগরের শিশুদের প্রথম কাজ হচ্ছে বাগানের পরিচর্যা করা। এটা স্কুলের নিয়মিত কাজেরই অন্তর্গত।

স্বপ্ননগর একটি স্বপ্নের নাম। যেখানে বাচ্চারা স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ননগরের উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা। বাল্যবিবাহ ঠেকাতে অনেক বাতচিৎ, বাদানুবাদ, স্কুল উঠিয়ে দেওয়ার হুমকি, রাগারাগি সবই স্বপ্ননগরের উদ্যোক্তাদের সহ্য করতে হয়, তবুও স্বপ্ননগরের কর্মচারীরা আশা রাখেন একদিন তাঁরা বাল্যবিবাহের মূল কারণ চিহ্নিত করে সেগুলোকেই ঠেকিয়ে দিতে পারবেন।

স্বপ্ননগরের উদ্যোক্তারা পুরো ক্যাম্পাস এবং পাঠদানের বিষয়টিকে ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা করছেন, যাতে বিশ্বের অন্য প্রান্ত থেকেও যেকেউ অনলাইনে শিক্ষাদানের কাজে সম্পৃক্ত হতে পারেন
ছবি: সংগৃহীত

বাল্যবিবাহ এবং চাইল্ড লেবার স্বপ্ননগরের স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। প্রাইমারি পর্যন্ত সবাই স্কুলে এলেও হাইস্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামের পরিসংখ্যান মোটেও আশাপ্রদ নয়। সেটার একটা সমাধান হতে পারে হাইস্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা। আগে মেয়েদের ১০–১২ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যেত। পরে স্কুল প্রতিরোধ করায় এখন অভিভাবকেরা ১৫-১৬ বছর বয়সে তাদের বিয়ে দিতে চান। মা–বাবাদেরও এ ক্ষেত্রে দোষ দেওয়া যায় না। গ্রামে মেয়েরা সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে বা কোনো ছেলে তাদের রাস্তায় উত্ত্যক্ত করলে সেটার দোষ মেয়ের ওপরেই চলে আসে। আর ছেলেরা কাজ করার মতো হাত–পা বড় হলেই আয়ের উৎস হিসেবে কাজে লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য স্বপ্ননগরের উদ্যোক্তারা একটা বৃত্তির কথা ভাবছেন। কেউ যদি মাধ্যমিক পর্যন্ত শেষ করে এবং মেয়ে ১৮ ও ছেলে ২১ পর্যন্ত বিয়ে না করে, তাদের জন্য ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একটা ডিপিএস বা এফডি খুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। জীবনগড়া প্রোগ্রামের আওতায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন ছাত্রছাত্রী তাঁদের মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছেন। এর মধ্যে চারজন উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছেন। ওই সম্প্রদায় থেকে এরাই প্রথম কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছেন।

পাঠদানকে আনন্দদায়ক করতে স্বপ্ননগরের শিশুদের জন্য পাঠাগার ও নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ রয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ননগরের উদ্যোক্তারা পুরো ক্যাম্পাস এবং পাঠদানের বিষয়টিকে ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা করছেন, যাতে বিশ্বের অন্য প্রান্ত থেকেও যেকেউ অনলাইনে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের কাজে সম্পৃক্ত হতে পারেন। কিন্তু সেখানে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে ইন্টারনেট। পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেটের সংযোগ খুবই দুঃসাধ্য একটি বিষয়, তবুও তাঁরা ইতিমধ্যেই ব্র্যাকনেটের কাছ থেকে কোটেশন নিয়েছেন এবং দেশের উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রবাসী অনেকেই সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে স্বপ্ননগরের সব কার্যক্রম ডিজিটালাইজ হতে যাচ্ছে। এতে তাঁদের শিক্ষার মান দ্রুতই বিশ্বমান অর্জন করবে।

স্কুলশিক্ষার্থীদের নিজ হাতে বানানো শহীদ মিনার
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ননগর একটি স্বপ্নের নাম। যেখানে বাচ্চারা স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষাটা হাতে–কলমে হওয়াতে সেটা বাচ্চাদের জন্য শেখা অনেক সহজ। আর পড়াশোনার সব কাজ যেহেতু ক্লাসেই শেষ করে দেওয়া হয়, তাই বাচ্চাদের ওপর আলাদা কোনো চাপও পড়ে না। এ ছাড়া তাদের বাগান করার মতো কাজে প্রতিদিন সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, যার ফলে তাদের বেড়ে ওঠাটা হচ্ছে প্রকৃতির নিবিষ্ট সহযোগে। আর স্বরচিত গল্প, কবিতা এবং অভিনয়ের পাঠের মাধ্যমে তাদের দেওয়া হচ্ছে জীবনের সম্যক ধারণা। স্বপ্ননগরের কান্ডারিরা তাই স্বপ্ন দেখেন স্বপ্ননগরের ছাত্রছাত্রীরা একদিন বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বয়ে আনবে দেশের সম্মান।

*লেখক: মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া