মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

‘মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনায় উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ্ জামান (বাঁয়ে)ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বৈশ্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় শিক্ষার ভূমিকা তুলে ধরতে ২৪ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘এআই ও শিক্ষা: প্রযুক্তির যুগে মানবিক ক্ষমতা রক্ষা’।

দিবসটি উপলক্ষে প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করে ‘মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা। এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ্ জামান। আধুনিক বিশ্বে ‘এআই’ কতটা শিক্ষাবান্ধব, এর দ্বারা আগামী প্রজন্ম কতটুকু লাভবান হবে, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যক্তি ও কর্মজীবনে কতটা জরুরিসহ শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক।

অনুষ্ঠানটি গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে একযোগে প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম, প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।

শুরুতেই দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ্ জামান বলেন, ‘বিশ্ব এখন যে যুগের মাধ্যমে যাচ্ছে, এটাকে বলা হয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। যার গুরুত্বপূর্ণ দিকই হলো প্রযুক্তি। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষায়ও এআইকে যুক্ত করার জন্য এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’

কিন্তু ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ শিক্ষার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না—আনিসুল হকের এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লাহ্ জামান বলেন, ‘এটাকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। কারণ, উন্নত বিশ্বে এটাকে তাদের কারিকুলামসহ বাস্তবিক দক্ষতা বৃদ্ধির উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উরুগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ আটটি দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে এআইকে যুক্ত করেছে। এখানে একটু বলি, আমেরিকান শিক্ষাবিদ বেঞ্জামিন ব্লম ১৯৫৬ সালে “ব্লম টেকজোনমি” নামে একটি শিক্ষা গ্রহণের তত্ত্ব দিয়েছেন। সেখানে তিনটি ডোমেইনের কথা বলেছেন। সেগুলো হলো কগনেটিভ, ইফেক্টিভ ও সাইকোমোটর।’ তিনি বলেন, যেখানে কগনেটিভ ডোমেইন জ্ঞানভিত্তিক, ইফেক্টিভ ডোমেইন মানসিক এবং সাইকোমোটর হচ্ছে শারীরিক দক্ষতা ও বোধগম্যতার কথা বলে। লক্ষ করলে দেখা যায়, কগনেটিভ ছাড়া আর কোনো ডোমেইনই এআই দ্বারা সম্ভব নয়। সে কারণেই এআইকে শিক্ষার সহায়ক টুলস হিসেবে বিবেচনা করে শিক্ষায় যুক্ত করার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো উৎসাহ দিচ্ছে।

উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ্ জামান
ছবি: প্রথম আলো

এ পর্যায়ে উপস্থাপক অতিথির কাছে তাঁদের দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রসঙ্গে জানতে চান। ব্রিটিশ কারিকুলামে পরিচালিত হওয়া স্কুল দুটি কোন ভাবনা থেকে প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়তে সেগুলো কী ভূমিকা রাখছে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল্লাহ্ জামান বলেন, ‘যখন প্রথম স্কুল শুরু করি, তখন আমাদের ভাবনায় একটি বিষয়ই ছিল। সেটি হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন ব্রিটিশ কারিকুলামের পাশাপাশি দেশীয় ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে পিছিয়ে না পড়ে। সে কারণে আধুনিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি কারিকুলাম পরিকল্পনা করেছি। আর ব্রিটিশ কারিকুলাম একটি চমৎকার শিক্ষাক্রম। যার সঙ্গে যেকোনো জাতি মানিয়ে নিতে পারে। তাই কারিকুলামকে ঠিক রেখে অন্যান্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, যেখানে ফ্রেঞ্চ ভাষাটাকে যুক্ত করেছে, সেখানে আমরা আরবিকে বেছে নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘এর ফলে এ-লেভেল শেষ করে শিক্ষার্থীরা যখন ইউরোপের কোনো দেশে যাচ্ছে তখন জব মার্কেটটা তার জন্য সহজ হচ্ছে। কারণ, সে ইংরেজির পাশাপাশি আরবিও ভালো জানে। আর অতিরিক্ত হিসেবে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষাটা দিচ্ছি। যেখানে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় ও জাগতিক—দুটো শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। তাই আমরা প্রত্যাশা করি, ব্যতিক্রমী এ কারিকুলাম থেকে উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠবে।’

বিশেষ আলোচনা সঞ্চালনা করেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক
ছবি: প্রথম আলো

আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে উইটন এবং গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কতটা প্রযুক্তিবান্ধব?

এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ্ জামান বলেন, ‘স্কুলের প্রশাসন, শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা প্রদানে আমরা প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া ক্লাসরুমকেও আংশিকভাবে প্রযুক্তির আদলে সাজানোর চেষ্টা করেছি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের শিক্ষকরা যেন প্রযুক্তিসহ সামগ্রিক দিক থেকে দক্ষ হতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রেখেছি। উইটন ইন্টারন্যাশনাল এবং গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একজন শিক্ষক বছরে বিভিন্ন সময়ে মোট ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। যেখানে শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক, শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আইটিবিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলতেই পারি, আমরা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার পথেই হাঁটছি।’

বাংলাদেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ্ জামান বলেন, ‘দুর্ভাগ্য হলো, দেশের নীতিনির্ধারকেরা আমাদের জন্য একটি কারিকুলাম এখনো পর্যন্ত ঠিক করতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে একটি কারিকুলাম প্রণীত হলো, যা ২০১০–এ বাতিল হলো। তারপর ২০২১–এ পরিবর্তন হলো। এটা কেন হচ্ছে? কারণ, কোনো প্রকার গবেষণা ও সদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছাড়াই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং সেটির প্রয়োগ। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এর জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে বিশেষজ্ঞদের অনেক অভাব। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে সুনজর দিতে হবে।’

অনুষ্ঠানের শেষে অতিথি ও দর্শকদের ধন্যবাদ জানিয়ে উপস্থাপক আনিসুল হক বলেন, ‘এআই নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এটি কখনোই মানুষের স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে না। কারণ, মানুষ সামাজিক জীব, যন্ত্রের সঙ্গে জ্ঞানের আদান-প্রদান করে প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারবে না। তাই আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, এআই মানুষকে নয়, মানুষই যেন এআইকে পরিচালনা করে।’