দুই পাঠ্যবই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত রাতের বৈঠকে, অন্যান্য বইয়েও আছে ভুল, অসংগতি

শিক্ষাবর্ষ শুরুর ১ মাস ১০ দিনের মাথায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল সরকার।

প্রত্যাহার হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ।

পাঠ্যপুস্তকের নানা ভুল ও অসংগতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ের ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির দুটি বই অনেকটা আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করে নিল। গতকাল শুক্রবার বিকেলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কথা জানিয়েছে।

শিক্ষাবর্ষ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পর এভাবে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন বলছেন শিক্ষাবিদেরা। পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা সরকারি সংস্থা এনসিটিবি গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি পাঠদান হতে প্রত্যাহার করা হলো।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে, যা শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের নাম একই।

পাঠদান প্রত্যাহার করা বই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নেওয়া হবে। আর বাকি তিনটি বই (ষষ্ঠ শ্রেণির অন্য দুটি বই এবং সপ্তম শ্রেণির আরেকটি বই) সংশোধন করা হবে। এখন পর্যন্ত এটুকুই সিদ্ধান্ত। এরপর যে সিদ্ধান্ত হবে, সেটি জানানো হবে।
মো. ফরহাদুল ইসলাম, এনসিটিবির চেয়ারম্যান

এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, দুটি বইয়ের পাঠদান প্রত্যাহার করা মানে, এই দুটি বই কার্যত বাতিল করে দেওয়া হলো। এখন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বইগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে আনা হবে। পরবর্তী সময়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকার কথা স্বীকার করলেও তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে—সরকারের দিক থেকে এমন বক্তব্যও দেওয়া হচ্ছিল। ভুল সংশোধন করার বেশ কিছু উদ্যোগও সরকার নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কেন দুটি বই বাতিল করতে হলো, সে বিষয়ে এনসিটিবি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলেনি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তথ্যগত ভুলের চেয়েও বই দুটি বাতিল করা হয়েছে মূলত ‘রাজনৈতিক’ কারণে। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠন এই দুটি বইয়ের বিষয়ে বেশি আপত্তি তুলেছিল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। এমনকি বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও ‘ভুলে ভরা’ এবং অসংগতিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক বাতিল করার দাবি তোলা হয়েছিল।

এনসিটিবির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে গতকাল দুপুরে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার একটি মাদ্রাসা মাঠে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে দুটি নতুন বই তৈরি করে দেওয়া হবে। দুই বইয়ে (প্রত্যাহার হওয়া) ইসলামবিরোধী কিছুই নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের কথা শুনি, যদি কেউ মনে কষ্ট পায়, সেটাকেও গুরুত্ব দিই এবং সম্মান করি।’

তাঁদের সবাই হয়তো সব বানান সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন না–ও হতে পারেন। এ জন্যই এই কাজগুলো এনসিটিবির সম্পাদনা শাখার মাধ্যমে দেখা হয়। আরেকটু যত্নবান হলে বানান ভুলের ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব হতো।
প্রীতিশ কুমার সরকার, এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখার সাবেক প্রধান সম্পাদক

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং পাঠ্যবই ও নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে যুক্ত কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন। সেখানে বই নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের বিষয়গুলো যেমন উঠে আসে, তেমনি বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়েও আলোচনা হয়। বইগুলোর প্রাথমিক পর্যালোচনায় শিক্ষা বিভাগ দেখতে পেয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটির অনেক বিষয়বস্তু আছে, যা এই বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী নয়। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়, বই দুটি প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।

এর আগে বই নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে আরেকটি কমিটি করেছিল। কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন আসার আগেই বই দুটির পাঠদান প্রত্যাহার করা হলো।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাঠদান প্রত্যাহার করা বই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নেওয়া হবে। আর বাকি তিনটি বই (ষষ্ঠ শ্রেণির অন্য দুটি বই এবং সপ্তম শ্রেণির আরেকটি বই) সংশোধন করা হবে। এখন পর্যন্ত এটুকুই সিদ্ধান্ত। এরপর যে সিদ্ধান্ত হবে, সেটি জানানো হবে।

‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আদি নামের বিকৃতিকরণ কেন’ শীর্ষক কলামে লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘চিংড়ি’ খাল নামে কোনো খাল নেই। এটি হবে, ‘চেংগী’ বা চেঙ্গী নদী। রাঙামাটি জেলার বুড়িঘাটে চেঙ্গী নদীর পারে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি রয়েছে।
ইলিরা দেওয়ান, উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক

উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠনের চাওয়া অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

পাঠদান প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হওয়া ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের এক জায়গায় বলা হয়, ‘অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব হয়েছে নাকি বানর থেকে। এ কথা ভুল।’ আরেক জায়গায় রয়েছে, ‘তোমাদের মনে রাখতে হবে, বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি।’

একই শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুশীলন’ বইয়ের (প্রত্যাহার হয়নি) ১১৩ পৃষ্ঠায় এক জায়গায় নিসর্গ নামে এক শিক্ষার্থীর প্রশ্ন ছিল, ‘আমি শুনেছি, আমাদের আদি পুরুষেরা নাকি বানর ছিল। তখন শিক্ষক খুশি আপা হেসে বললেন, তাই নাকি! অনেকেই মনে করে, বানর আমাদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু তথ্যটা সঠিক নয়। বানর আমাদের পূর্বপুরুষ নয়।’ তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে, বইয়ে আছে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি, যা আসলে বইয়ে নেই।

পাঠ্যবইয়ে এত বেশি মাত্রায় ভুলভ্রান্তির কারণ হলো অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা। এ জন্য সমালোচনা হবেই। কিন্তু অযৌক্তিক সমালোচনাও হচ্ছে। ভুলভ্রান্তি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংশোধন করতে হয়।
মনজুর আহমদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক

অন্যান্য বইয়েও ভুল-অসংগতি

গত ১ জানুয়ারি প্রথম, ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নব্যবস্থা, পড়ানোর ধরন এবং বইগুলো পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এত বড় পরিবর্তন হলেও বাস্তবায়নের কাজটিতে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতিতে যেমন হেলাফেলা ছিল, তেমনি বইগুলোও তাড়াহুড়ো করে বের করতে গিয়ে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি ও অসংগতি রয়ে গেছে।

মাধ্যমিক স্তরের ১০ জন শিক্ষকের মাধ্যমে প্রথম, ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির বেশির ভাগ পাঠ্যবই পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। ১০ জন শিক্ষকই ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁরা নতুন বইয়ে নানা রকমের ভুল ও অসংগতি এবং বানান ভুল দেখতে পেয়েছেন। এ ছাড়া এনসিটিবির কর্মকর্তাদের কাছেও কোনো কোনো শিক্ষক নিজ উদ্যোগে পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন ভুল চিহ্নিত করে পাঠিয়েছেন।

ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’-এর ৯৮ পৃষ্ঠায় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজিকে সুদূর তুরস্ক থেকে আগত বলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা বলছেন, এটি হবে ‘গজনি’ থেকে।

বিষয়টি নিয়ে আরও যাচাই করতে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের কাছে গেলে তিনি এ প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে বিভাগের লাইব্রেরিতে গিয়ে ইতিহাসবিষয়ক অন্যতম নির্ভরযোগ্য বই তবকাত-ই-নাসিরী বের করে দেখান। ওই বইয়ে উল্লেখ আছে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি ঘোর ও গরমসির রাজ্যের (আফগানিস্তানের গরমসির এখন দস্ত-ই-মার্গ নামে পরিচিত) খলজি সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তিনি গজনি থেকে হিন্দুস্তানে (ভারতবর্ষ) আসেন।

একই বইয়ের পৃষ্ঠা ১২৮–এ বলা আছে, ‘চলো এবার, সবাই বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠা বের করি। তোমরা সবাই কি ভাষা মানচিত্র দেখতে পাচ্ছ? সবাই বই খুলে ভাষা মানচিত্র দেখতে লাগল।’ অথচ ৩২ পৃষ্ঠায় সেই ছবি নেই। বইয়ে ‘ভাষা মানচিত্র’ আছে ১২৯ পৃষ্ঠায়। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’ বইয়ের পৃষ্ঠা ২৭–এ যে ছবিগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুবই অস্পষ্ট। বইয়ের পৃষ্ঠা ৭২–এ ভাষাশহীদদের ছবি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাম দেওয়া হয়নি। শিক্ষকেরা বলছেন, এখানে ছবির নিচে নাম দেওয়া উচিত ছিল, যাতে শিক্ষার্থীরা চিনতে পারে।

কালো বিড়ালের ছবি কালো নয়

প্রথম শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় ‘ব্ল্যাক ক্যাট’–এর যে ছবি দেওয়া হয়েছে, তা কালো নয়। এখানে সঠিক রং ব্যবহৃত হয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণির ‘জীবন-জীবিকা’ বইটি তুলনামূলক ভালো।

বইয়ের বিষয়বস্তুও ভালো। তবে লেখায় ছন্দের ঘাটতি আছে। যেমন ‘কাজের মাঝে আনন্দ’ অধ্যায়ের পৃষ্ঠা ৪–এ আছে, ‘তাহলে চল, প্রত্যেকেই শপথ নিই—আজ থেকে আমার কাজ আমি করি, সুন্দর একটা জীবন গড়ি’। শিক্ষকেরা বলেছেন, এখানে হতে পারত, ‘তাহলে চল, সবাই আজ শপথ নিই, নিজের কাজ নিজে করব, আনন্দময় জীবন গড়ব।’ বইটির ‘বিদ্যালয়ে আমাদের দায়িত্ব’ শীর্ষক অংশে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘মন ব্যথার ঘটনা ঘটলে’। এখানে হবে ‘মন খারাপের ঘটনা ঘটলে’।

শিক্ষামন্ত্রী নিজেও বইয়ে

সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুশীলন বই’–এ ‘সরকার পরিচালনায় নারী’ শীর্ষক অংশে সরকার পরিচালনায় দেশের নারীরা কীভাবে ভূমিকা রেখে চলছেন, সেই আলোচনা এসেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নামও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে তথ্যগত ভুল নেই। কিন্তু এটি খণ্ডিত তথ্য। কারণ, বর্তমান মন্ত্রিসভাকে বিবেচনায় নিলেও শিক্ষামন্ত্রীর পাশাপাশি আরও দুজন নারী প্রতিমন্ত্রী ও একজন নারী উপমন্ত্রীর নাম আসতে পারত।

আবার জাতীয় সংসদের প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের নামও থাকতে পারত। এ ছাড়া নিকট অতীতে সরকার পরিচালনায় নারীদের যুক্ততার কথা বললে আরও কয়েকজন নারীর কথা আসতে পারত।

বানান ভুলের ছড়াছড়ি

পাঠ্যবইয়ে তথ্যগত ভুল ও অসংগতির পাশাপাশি বানান ভুলের ছড়াছড়ি হয়েছে। যেমন সপ্তম শ্রেণির ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বইয়ে ৪০টির বেশি বানান ভুল চিহ্নিত করেছেন শিক্ষকেরা। যেমন বইটির পৃষ্ঠা ২৩-এ লেখা হয়েছে ‘কম্পিঊটার’। হবে ‘কম্পিউটার’।

অন্যান্য বইয়েও এ রকম অসংখ্য বানান ভুল রয়েছে। যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’–এর পৃষ্ঠা ১৩–এর এক জায়গায় লেখা আছে, নিউটনের মহাকর্ষের ‘তত্ত’। আসলে হবে ‘তত্ত্ব’। একই বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠায় ‘সদস্যদে’। এটি হবে ‘সদস্যদের’। ষষ্ঠ শ্রেণির ‘জীবন-জীবিকা’ বইয়ের ৪১ পৃষ্ঠাতেই অন্তত সাতবার ‘বৃত্তিমুলক’ লেখা হয়েছে, যা হবে আসলে ‘বৃত্তিমূলক’। ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে বানান ভুল হয়েছে। যেমন বইটির ১৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘Agesz'। হবে ‘ages’।

এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখার সাবেক প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা বই লেখেন, তাঁদের সবাই হয়তো সব বানান সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন না–ও হতে পারেন। এ জন্যই এই কাজগুলো এনসিটিবির সম্পাদনা শাখার মাধ্যমে দেখা হয়। আরেকটু যত্নবান হলে বানান ভুলের ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব হতো।

পুরোনো শিক্ষাক্রমের বইয়েও ভুল

নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ এবং ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ে ভুল ছিল। এর মধ্যে ৯টি ভুলের সত্যতা পেয়ে কয়েক দিন আগে সংশোধনী দিয়েছে এনসিটিবি। এই বইগুলো ২০১২ সালে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি।

পুরোনো শিক্ষাক্রমের পঞ্চম শ্রেণির ‘আমার বাংলা’ বইয়ের ‘বীরের রক্তে স্বাধীন এ দেশ’ শীর্ষক অধ্যায়ে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের মহান মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণের বর্ণনা দিতে দিয়ে বলা হয়, ‘...তাঁরা মহালছড়ির কাছে বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন।’

কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আদি নামের বিকৃতিকরণ কেন’ শীর্ষক কলামে লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘চিংড়ি’ খাল নামে কোনো খাল নেই। এটি হবে, ‘চেংগী’ বা চেঙ্গী নদী। রাঙামাটি জেলার বুড়িঘাটে চেঙ্গী নদীর পারে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি রয়েছে।

পাঠ্যবইয়ে ভুল, অসংগতি এবং হঠাৎ করেই দুটি বই প্রত্যাহার করার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে এত বেশি মাত্রায় ভুলভ্রান্তির কারণ হলো অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা। এ জন্য সমালোচনা হবেই। কিন্তু অযৌক্তিক সমালোচনাও হচ্ছে। ভুলভ্রান্তি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংশোধন করতে হয়।

সরকার এ জন্য দুটি কমিটিও করল। সেই কমিটির মাধ্যমে পর্যালোচনা করে দেখা যেত, কোথায় কী ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। কিন্তু তাদের প্রতিবেদন আসার আগেই যেভাবে দুটি বই হঠাৎ পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করা হলো, তাতে বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মতোই হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। সরকার হয়তো রাজনৈতিক কারণে নিজেদের বিব্রত মনে করছে। এভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে কাজটি করা উচিত ছিল।