পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাসহ ১২ দফা দাবি

ছবি: প্রথম আলো

আমরা শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ অনেকেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় লক্ষ করছি, প্রতিবছর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লাখো শিক্ষার্থী সব কটি বা বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা ফি দিয়ে আবেদন করার সক্ষমতাও অনেক শিক্ষার্থীর থাকে না। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিটে আবেদন করা এবং পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া যেসব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শ্রুতলেখক নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, তাদের পক্ষে কতবার সাহায্যকারী নেওয়া যায়? এমবিবিএস এবং বিডিএস একটি ফরম পূরণে একবারে ফি দিয়ে কয়েক বছর ধরে সফলভাবে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করছে।

২০২৫ -২৬ শিক্ষাবর্ষে শুধু বিজ্ঞান ও বিভাগ পরিবর্তনকারী একজন শিক্ষার্থীর ১২/১২/২৫ থেকে ৩১/১/২০২৬ তারিখের মধ্যে কমবেশি ২৪-২৬ বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে বা দিতে পারবে, আবেদন করলে দিতে হবে। এতগুলো পরীক্ষা দেওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য মানসিক, শারীরিক ঝুঁকি ও ধকল থাকে আর থাকে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ার অবসাদ। অভিভাবক হিসেবে পোহাতে হয় আবেদন খরচ ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া যাতায়াত, কোচিং, পরীক্ষার জন্য আবাসন ব্যয়ও তো আছে। আর যে শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা প্রতিযোগিতায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে এক বছর পিছিয়ে গেলে, তার দায় কে নেবে? এসব সমস্যা সমাধানের জন্য জনমত তৈরিতে আমরা নানা কর্মসূচি পালন করেছি। এ জন্য আমরা প্রেসক্লাবের সামনেও কর্মসূচি পালন করেছি। আমাদের এই দেশের সাধারণ জনগণের পক্ষে এই বোঝা বহনের অপারগতায় জাতীর বিবেচনার জন্য আমরা কিছু প্রস্তাব ও দাবি রাখছি।

১. সরকারিভাবে একটিমাত্র ভর্তি আবেদন করে যোগ্যতা অনুযায়ী ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে যাচাই করার সুযোগ।

২. কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তির কার্যক্রম সম্পাদন করতে হবে।

৩. বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির নামে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

৪. ভর্তি পরীক্ষার নামে একবারের বেশি কোনো ফি আদায় করা যাবে না, সর্বোচ্চ দু–তিন স্তরের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যাবে।

৫. এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ভর্তি পরীক্ষাটি গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ৬০দিনের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি, ৯০ দিনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা সারা দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত করতে হবে।

৬. একজন শিক্ষার্থীর ২০০ নম্বরের সমন্বিত (এমসিকিউ+লিখিত) এবং সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টার একটি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে, জিপিএসহ ৩০০ নম্বরের জাতীয় মেধা তালিকা প্রণয়ন করে চূড়ান্ত ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. আলাদা আলাদা কোডে আবেদন ফি, ভর্তি ফি, মাইগ্রেশন ফি গ্রহণ করবে। প্রতিটি ফি একজন শিক্ষার্থীর নিকট একবারই নেওয়া যাবে।

৮. ফলাফল প্রকাশের পর ৩-৫ মাসের মধ্যে পরবর্তী সেশনে ক্লাস শুরু করতে হবে। শূন্য সেশনজট জাতিকে উপহার দিতে হবে।

৯. যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হোক না কেন, শিক্ষাবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা সমসাময়িক সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

১০. প্রতিবছর ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করতে হবে এবং এর মধ্যে ১-৭/১০ নম্বর র‍্যাঙ্কধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান অনুযায়ী দায়িত্ব পাবে ভর্তি পরীক্ষা মূল ব্যবস্থাপনার, বাকি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান সম্পূরক হিসেবে সাবকমিটির দায়িত্ব নিয়ে সুষ্ঠু পরীক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করবে। সফলতা ও ব্যর্থতার দায় সব প্রতিষ্ঠানের ওপর সমানভাবে বর্তাবে।

১১. ভর্তি কার্যক্রম থেকে প্রাপ্ত আবেদন ফি সুষম বণ্টন করতে হবে, ভর্তি ফি সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাবে, মাইগ্রেশন ফি সমবণ্টন করতে হবে।

১২. স্বচ্ছ কেপিআই (কি পারমরম্যান্স ইন্ডিকেটর) সিস্টেমের মাধ্যমে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে বা অর্থবর্ষ শুরুর ৩ মাস আগেই সামগ্রিক কেপিআই মূল্যায়ন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করতে হবে। যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যথাসময়ে র‍্যাঙ্কিংয়ে অংশগ্রহণ না করলে সে রেলিগেশনে যাবে বা ইউজিসি সিদ্ধান্ত নেবে।

ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগে অভিভাবকের সঙ্গে এক পরীক্ষার্থী
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সমাধানের কিছু রোডম্যাপ যা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনযোগ্য

১. একটিমাত্র আবেদন যোগ্যতা অনুযায়ী ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অর্থ, সময়, সেশন, পেরেশানি, হয়রানি কমে যাবে।

২. ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পছন্দক্রম অনুসারে জাতীয় মেধাতালিকা প্রণয়ন করে বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির তালিকা প্রকাশ করতে হবে।

৩. ভর্তির আবেদনের সময় সব বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিং ও প্রকৃতি অনুযায়ী সাধারণ, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি , মেডিকেল, বিভাগ পরিবর্তনসহ সব প্রয়োজনীয় টায়ার সিলেক্ট করার মাধ্যমে শিক্ষার্থী পছন্দক্রম প্রকাশ করবে।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সাবজেক্ট ও বিভাগওয়ারি ভর্তির প্রক্রিয়া ডিসক্লোজ করবে, সফটওয়্যারে লজিক সেট হবে এবং ক্রাইটেরিয়া যুক্ত হবে প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী। ফলে একটা সুন্দর ইউনিক সিস্টেম দাঁড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

৫. বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এমবিবিএস, কৃষি, গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিভিন্নভাবে সফটওয়্যার তৈরি আছে। আমাদের কাজ হবে সমন্বিত পদ্ধতিতে শুধু এক্সপানশন করা এবং এক্সপানশন করতে সম্মত করা, সফটওয়্যারে প্রয়োজনীয় ব্যাক এবং সামনে টায়ার যুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া।

৬. ভর্তি গ্রহণকারী সংস্থাটি শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর জিপিএ এবং ভর্তি পরীক্ষায় অর্জিত নম্বরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদাকৃত ভর্তি ক্রাইটেরিয়ার আলোকে পছন্দ ক্রমানুসারে র‍্যাঙ্কিং প্রদান করবে।

৭. র‍্যাঙ্কিং প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ একটি টায়ার সিলেক্ট করে ভর্তি নিশ্চায়ন করবে এবং চাইলে মাইগ্রেশন অন বা অফ রাখতে পারবে। মাইগ্রেশন অন রাখলে সাবজেক্ট পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ পাবে, অন্যথায় ওটাই তার চূড়ান্ত ভর্তি বলে বিবেচিত হবে।

৮. যে শিক্ষার্থী ভর্তি নিশ্চায়ন করল, তার অন্য সব বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের প্রার্থিতার অবসান ঘটবে এবং পরবর্তী র‍্যাঙ্কিং থেকে মাইগ্রেট হবে, এরপর প্রতি ১০ দিন পরপর তালিকাটি আপডেট হয়ে যাবে। প্রথম ১৫ দিনের পরেই শিক্ষার্থীরা মূল ভর্তির অ্যাকাউন্টে অনলাইনের মাধ্যমে টাকা পেমেন্ট করে দেবেন এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা তথ্যসমূহ জমা দেবে।

আমাদের প্রচেষ্টায় আমরা প্রচলিত পদ্ধতির সঙ্গে সংগতি রেখেই একটি পূর্ণ সমন্বিত পদ্ধতি প্রস্তাব করছি, যাতে সব বিশ্ববিদ্যালয় পাবে তাদের প্রত্যাশিত শিক্ষার্থী। মেধা যাচাইয়েরও সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। ভর্তি হতে পারবে তাদের কাঙ্ক্ষিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর্থিক ও দূরবর্তী কারণে বঞ্চিত হতে হবে না উচ্চশিক্ষা লাভের অধিকার থেকে। ভর্তির আগেই সেশনজটমুক্ত হয়ে ভর্তি হবে শিক্ষার্থীরা।

*লেখক: মো. সাজ্জাদ আল আমীন, অভিভাবক ও হাফিজা আফরোজ, অভিভাবক এবং আহ্বায়ক বাংলাদেশ শিক্ষার্থী ও আভিভাবক সমন্বয় পরিষদ