রাজধানীতে তিনতলা স্কুল ভবনে রডের বদলে পাইপ, মাত্র দুটি কক্ষে চলছে ক্লাস

রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

তিনতলা ভবনটির বয়স ৩২ বছর। তবে প্রথম দেখায় যেকারও কাছে ভবনটিকে বহু পুরোনো মনে হতে পারে। ‘যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে’—এমন জীর্ণ দশা ভবনটির। ইট–সুরকি ঝরে যাওয়ার পর ‘আবিষ্কার’ হলো ভবনের কলামে (বিমে) রড–কংক্রিটের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে পাইপ। রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে চারপাশের সুরম্য ভবনগুলোর মধ্যে বড্ড বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে এটাই একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা ভবনের স্কুলটির দরজা, জানালা, মেঝে, কলাম, কলাপসিবল গেট—কোনো কিছুই ঠিকঠাক নেই। ভবনের সামনের অংশের কলামের পলেস্তারা ধসে পাইপ বের হয়ে আছে। স্কুলের শিক্ষকদের ভাষায়, কলামের ভেতরে রড-সিমেন্ট থাকার কথা। অথচ কলামের ওপরের সিমেন্টের আস্তরণ ধসে যাওয়ার পর রডের পরিবর্তে পাইপ দেখা যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা স্কুলটি পরিদর্শনে এসে এটাকে মৌখিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে পরিত্যক্ত ঘোষণার কথা বলেছিলেন বলে জানা গেছে শিক্ষকদের কাছ থেকে। অথচ প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে শিশুরা।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক নীপা ব্যাপারী বলেন, ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদল স্কুল পরিদর্শন করেছে। প্রতিনিধিদল স্কুলটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে মৌখিকভাবে স্কুলটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। তবে পরিত্যক্ত ঘোষণার কোনো লিখিত নির্দেশনা নেই।

ভবনটি তিনতলা হলেও পাঠদান চলে নিচতলার মাত্র দুটি কক্ষে। জরাজীর্ণ দশার কারণে ওপরের দুটি তলায় পাঠদান বন্ধ রেখেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, দেয়াল থেকে ইট–সুরকি ভেঙে ভেঙে মেঝেতে পড়ে আছে। দোতলার তিনটি কক্ষ এবং তৃতীয় তলার একটি কক্ষ তালা দেওয়া। তৃতীয় তলার একটি কক্ষ খোলা, তাতে ভেজা কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে। বারান্দা বরাবর কক্ষে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন স্কুলের দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরীর দায়িত্বে থাকা রাসেল আহমেদ। তিনি বলেন, কোভিডের আগে পুরো তিনতলাজুড়ে ক্লাস হতো। এখন ওপরের দুটি তলা ক্লাস করার অনুপযোগী হওয়ায় শুধু নিচতলার দুটি কক্ষে এবং এ ভবনের পাশে নির্মিত একতলা ভবনের একটি কক্ষে ক্লাস চলে। ঝুঁকিপূর্ণ হলে পরিবার নিয়ে কেন বাস করছেন, জানতে চাইলে রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমার পদে নিয়োগের শর্তেই আছে স্কুলে থাকতে হবে। আর স্কুলের বাইরে থাকলে অনেক খরচ।’

ঝুঁকি নিয়েই চলছে ক্লাস
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, স্কুলে মোট শিক্ষার্থী ৩৫২ জন। প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষক ১৩ জন। স্কুলটির বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ওই এলাকার অভিজাত বাড়িগুলোর নিরাপত্তাপ্রহরী, তত্ত্বাবধায়ক, গাড়িচালক, গৃহকর্মীর সন্তান। তবে এলাকায় নামীদামি বেসরকারি স্কুল থাকলেও সেখানে মূলধারায় পড়ানোর সুযোগ না পেয়ে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বেশ কিছু শিশুকে এ স্কুলে ভর্তি করেছেন অভিভাবকেরা। স্কুল ছুটির পর বেলা তিনটা থেকে ঝরে পড়া ও শ্রমজীবী শিশুদের জন্য সরকারের শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান চলে স্কুল ভবনের নিচতলায়।

তিন কক্ষে ঠাসাঠাসি করে ক্লাস, মাঠেও ক্লাস হয়েছে

স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা গেছে, শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এক কক্ষে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বসাতে হচ্ছে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। বেলা ১১টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, বোর্ডে লেখা উপস্থিত ৪৭ জন। তবে রোকসানা আক্তার নামের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানাল, বোর্ডে উপস্থিতির সংখ্যা লেখার পর আরও অনেকে ক্লাসে এসেছে। পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিত ছিল ৫০ জন।

রাজধানীর বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল ভবনে রডের বদলে পাইপ
ছবি: প্রথম আলো
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণের কাজ করছে এলজিইডি। নির্মাণকাজ খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত করলেও কবে নাগাদ কাজ করা যাবে, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, স্কুলের মাঝখান দিয়ে রাজউকের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

স্কুলের শিক্ষক জাহানারা খাতুন বলেন, একেক শ্রেণিতে দুটি করে সেকশন থাকলেও শ্রেণিকক্ষের সংকটে দুই সেকশনের ক্লাস একসঙ্গে করাতে হচ্ছে। এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসাতে হয় বলে শৃঙ্খলা রাখতে কখনো কখনো একসঙ্গে দুজন শিক্ষককে থাকতে হয় ক্লাসে।

বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনে মাত্র দুটি কক্ষ ক্লাস করার উপোযাগী
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষক আমেনা বেগম বলেন, ক্লাস করাতে গেলে অনেক সময় ওপর থেকে সিমেন্ট খসে খসে পড়ে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাসে থাকতে হয়।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তাদের এ ভবনে ক্লাস করতে ভয় লাগে। চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা সাজেদা বেগম বলেন, স্কুলটি এত জরাজীর্ণ। এটা ঠিক করা উচিত।

স্কুলের অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক নীপা বেপারী বলেন, তিনি থানা শিক্ষা অফিসকে স্কুলটির জরাজীর্ণ অবস্থার কথা জানান। এরপর ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল স্কুল পরিদর্শন করে। দলটি বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্কুলটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে মৌখিকভাবে স্কুলটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। তবে পরিত্যক্ত ঘোষণার কোনো লিখিত নির্দেশনা নেই।

প্রধান শিক্ষক জানান, করোনার আগে কয়েক মাস মাঠেও ক্লাস নেওয়া হয়েছে। করোনার সময় দেড় বছর স্কুল বন্ধ ছিল। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা পরিত্যক্ত করে নিচতলায় ক্লাস নেওয়া শুরু হয়।

রডের পরিবর্তে পাইপ, ভেঙে পড়তে পারে ভবন

স্কুল ভবনের কলামে পাইপ থাকার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)–এর নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, একটি ভবনের কলামে ইট, সিমেন্ট, কংক্রিট ও রড থাকে। কলামে পাইপ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাইপ দেওয়ায় ভবনের কাঠামো দুর্বল হয়ে আছে। এর ফলে অল্প মাত্রার ভূমিকম্পেও ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে। অথবা যেকোনো সময় এমনিতেও ভেঙে পড়তে পারে। খরচ কমাতে ঠিকাদার এ ধরনের কাজ করেছেন বলে মনে করছেন তিনি।

আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, ভালোভাবে বানালে ৩২ বছরে একটি ভবন এত দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা নয়। রডের বদলে যেহেতু পাইপ দেওয়া হয়েছে, তাই ধারণা করা যায়, ভবন নির্মাণে অন্যান্য উপকরণও ভালো দেওয়া হয়নি।

হোয়াটসঅ্যাপে ভবনের বিভিন্ন দিকের ছবি পাঠানো হয়েছিল আদিল মুহাম্মদ খানের কাছে। ছবি দেখে তিনি বলেছেন, ভবনটি একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এখানে ছাত্রছাত্রীরা খুবই অনিরাপদ অবস্থায় পড়ালেখা করছে। অত্যন্ত ভয়াবহ ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে ভবনটি। অতি দ্রুত ভবনটিকে ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করা প্রয়োজন।

স্কুলটি কবে ঠিক হবে

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে স্কুলের ভবন নির্মাণে সহসা কোনো সিদ্ধান্তে আসার বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শরীফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলটি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। তখন স্কুলটি আধপাকা একতলা ছিল। তিনতলা ভবনটির নির্মাণকাজ হয়েছে ১৯৯১ সালে। ভবনের অবস্থা দেখলে বোঝা যায়, ঠিকাদার ভালোভাবে কাজ করাননি। তিনি বলেন, ‘রাজউক স্কুলটিকে স্থায়ীভাবে জমি দেয়নি। রাজউকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্কুলের এ অবস্থা নিয়ে দুই সপ্তাহ আগে কথা বলেছি। তিনি একটি আবেদনপত্রের মাধ্যমে সবকিছু জানাতে বলেছেন। আবেদনপত্রটি শিগগির জমা দেব।’

প্রাথমিক স্কুলগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য সরকারের ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল মেয়াদে ১ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের নাম—‘ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ প্রকল্প’। এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন তৈরি করার কথা রয়েছে।
বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নীপা ব্যাপারী জানান, স্কুলটিকে ওই প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ ভবন নির্মাণের কাজ হবে, তা তিনি জানেন না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদল পরিদর্শন করে স্কুলটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে মৌখিকভাবে স্কুলটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। তবে পরিত্যক্ত ঘোষণার কোনো লিখিত নির্দেশনা নেই
ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণের কাজ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। নির্মাণকাজ খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় মাত্র ১৫টি স্কুলের নির্মাণকাজ চলছে। বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত করলেও কবে নাগাদ কাজ করা যাবে, বলা যাচ্ছে না। কারণ, স্কুলের মাঝখান দিয়ে রাজউকের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, রাজউকের মাস্টারপ্ল্যানে স্কুলই রয়েছে। স্কুলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরির কথা নয়।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থেকে শিশুদের সরিয়ে অন্য কোথাও পাঠদানের পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রাজউকের কাছ থেকে তিনটি প্লট পাওয়া গেছে। উত্তরা ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর সেক্টরে ৩টি স্কুল নির্মাণ করা হবে। সেখানে এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের একীভূত করা যায় কি না, সেটা দেখা যেতে পারে। তবে ওই তিন স্কুল নির্মাণ এখনো মাস্টারপ্ল্যান পর্যায়েই রয়েছে বলে তিনি জানান।