অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে কেমন প্রস্তুতি দরকার, শিক্ষার্থীদের করণীয় কী

অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে উচ্চশিক্ষার আবেদনের জন্য ফাস্ট ক্লাস অনার্স (H1) রেজাল্ট প্রয়োজনছবি: সংগৃহীত

উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে আসেন, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে। মূলত নর্থ-আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াই থাকে সবার পছন্দের শীর্ষে। এই দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের অন্যতম বহু সংস্কৃতির দেশ হিসেবে বেশ পরিচিত। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা ও স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমান।

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন ধরনের স্টাডি অপশন রেখেছে। কিন্তু বেশির ভাগই অনেক ব্যয়বহুল। যেমন এখানে ব্যাচেলর ডিগ্রি করতে চাইলে বছরে ২০ থেকে ৩২ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার টিউশন ফি দিতে হবে, যা অনেকেরই সাধ্যসীমার বাইরে। কিন্তু স্কলারশিপ নিয়ে আপনি এখানে মাস্টার্স বাই রিসার্চ (১.৫-২ বছর) বা পিএইচডি (৩-৪ বছর) করতে পারেন, যেখানে সম্পূর্ণ খরচ, যেমন টিউশন ফি ও লিভিং অ্যালাউন্স বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে, এমনকি আপনার প্লেনের টিকিট খরচও। লেখাটি মূলত তাঁদের জন্য, যাঁরা স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে মাস্টার্স বাই রিসার্চ/ পিএইচডি করতে ইচ্ছুক।

কোভিড-১৯-এর প্রকোপে সারা বিশ্ব এখন হিমশিম খাচ্ছে এবং অনেকেই ঘরবন্দী। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা তাঁদের মূল্যবান এই সময় উচ্চশিক্ষার পূর্বপ্রস্তুতির (আইইএলটিএস, স্কলারশিপের আবেদন ইত্যাদি) জন্য ব্যবহার করতে পারেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও করে দিচ্ছে। গ্লোবাল ট্যালেন্ট ইনডিপেনডেন্ট প্রোগ্রাম (জিটিআই) তার মধ্যে একটি। যেখানে ৭টি সেক্টরে অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫ হাজার জনকে এই অভিবাসনের সুযোগ দেওয়া হবে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া থেকে আবেদনকারী গ্র্যাজুয়েটরা এই ভিসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতগুলো ভিসা আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশিরা এর মধ্যে দ্বিতীয়। এই ভিসা আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে গবেষণাকেই মূলত প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কিছু স্কলারশিপ রয়েছে, যেটা সম্পর্কে ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটগুলোতে বিস্তারিত বলা আছে। তবে স্কলারশিপ পেতে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দিতে হবে-
*স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের ফল
অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে উচ্চশিক্ষার আবেদনের জন্য ফাস্ট ক্লাস অনার্স (H1) রেজাল্ট প্রয়োজন। স্কলারশিপের ক্ষেত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের রেজাল্টকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে ন্যূনতম সিজিপিএ-৩.৫ (৪-এর মধ্যে) হলে আপনি কিছুটা এগিয়ে থাকবেন। সিজিপিএ যদি কম হয়, সে ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু ভালো জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

ইংরেজিতে দক্ষতা
অস্ট্রেলিয়ায় স্কলারশিপের জন্য আইইএলটিএসে টোটাল ব্যান্ড স্কোর ৬.৫-সহ সব ব্যান্ডে ৬ থাকতে হবে। এ ছাড়া এখানকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাংশনাল ইংলিশ (উদাহরণস্বরূপ ‘মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন’) গ্রহণ করে থাকে। তবে আইইএলটিএস স্কোর থাকা ভালো। কারণ, এটি আপনার স্কলারশিপের সম্ভাবনাকে আরও বৃদ্ধি করবে।

সুপারভাইজারের সঙ্গে যোগাযোগ
বিষয় অনুযায়ী সুপারভাইজার খুঁজে বের করার পর তাঁকে ই-মেইল করুন। সুপারভাইজারের সুপারিশ আবশ্যক। ই-মেইল করার ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সংক্ষিপ্ত ই-মেইল, যেখানে আপনার বিষয় পছন্দের কারণ, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের রেজাল্ট, পাবলিকেশনের সংখ্যা, আইইএলটিএস স্কোর-এগুলোই বরং গুরুত্বপূর্ণ (সিভি-সংযুক্ত)। এ ক্ষেত্রে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট অথবা গুগল থেকে স্ট্যান্ডার্ড একাডেমিক সিভি ও কভার লেটারের ফরম্যাট দেখে নিতে পারেন।

আবেদনপ্রক্রিয়া
স্কলারশিপ অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে একটা রিসার্চ প্রপোজাল দিতে হয়। আপনি কী করতে চান, তার প্রয়োগ, রিসার্চ মেথডলজি, তার ওপর সংক্ষিপ্ত ২/৩ পৃষ্ঠা লিখতে হবে। এ ক্ষেত্রেও আপনি অনলাইন থেকে অনেক রিসার্চ প্রপোজালের ফরম্যাট দেখে নিয়ে নিজের মতো করে লিখতে পারেন। এ ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফরম্যাট থাকে, যা আপনি সরাসরি অনুসরণ করতে পারেন।

গবেষণাপত্র
মানসম্মত গবেষণাপত্র/পাবলিকেশন স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাবলিকেশনের ক্ষেত্রে সর্বদা প্রিডেটরি জার্নাল/ নাম-সর্বস্ব জার্নালকে পরিহার করা উচিত। কারণ, এ ধরনের গবেষণাপত্র স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে না আসার সম্ভাবনাই অনেকটা বেশি। সুতরাং, এ বিষয়ে সচেতন হলে উৎকৃষ্ট গবেষণা ভালো জার্নালে প্রকাশ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আপনি আপনার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস সুপারভাইজার এবং বিদেশে অধ্যায়নরত/ চাকরিরত পরিচিত গবেষকদের সাহায্য নিতে পারেন।

আইইএলটিএস স্কোর থাকা ভালো। কারণ, এটি স্কলারশিপের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে
ছবি: সংগৃহীত

পাঁচটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে স্কলারশিপ চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ আবেদনপত্রের ক্ষেত্রে প্রথম চারটি ঠিক থাকে, কিন্তু প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় মানসম্মত পাবলিকেশন। দুর্বল জার্নাল/ কনফারেন্স পেপার অধিকাংশ আবেদনের ক্ষেত্রে স্কলারশিপের সম্ভাব্যতাকে কমিয়ে দেয়। এ জন্য আবেদনকারীদের মানসম্মত পাবলিকেশনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি স্কলারশিপের ক্ষেত্রে পাবলিকেশনের ওপর ন্যূনতম ৯ পয়েন্ট অর্জন করতে হয়। ফাস্ট অথোর/ জার্নাল থাকলে তিন পয়েন্ট, বাকি ক্ষেত্রে এক পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল কোলাবরেশনের জন্য রয়েছে এক পয়েন্ট। এ ছাড়া জার্নাল/ কনফারেন্স পেপার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্কোপাস/ এসসিআই ইনডেক্সের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। মানসম্মত জার্নাল খুঁজতে ওয়েব ওব সায়েন্স, স্কোপাস অথবা সিমাগো-স্কপাস ইনডেক্স র‌্যাঙ্কিং জার্নাল বেছে নিতে পারেন।

ভালো মানের রিসার্চ পাবলিকেশন করতে হলে করণীয়
আন্ডারগ্রাড/ মাস্টার্সের থিসিসের প্রাপ্ত রেজাল্ট দিয়ে উচ্চমানের আন্তর্জাতিক জার্নালে রিসার্চ পেপার পাবলিশ করা সম্ভব, শুধু প্রয়োজন সঠিক নির্দেশনা। সে ক্ষেত্রে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের রিসার্চের প্রথম দিনগুলো থেকেই সচেতন এবং পরিশ্রমী হতে হবে। থিসিস সিলেকশনের সময় একটু স্টাডি করে নিতে পারেন কোন বিষয়ে গবেষণা করতে আপনি সব থেকে বেশি আগ্রহী এবং সেই রিসার্চ ফিল্ডের এক্সপার্ট/ প্রফেসর আপনার ডিপার্টমেন্টে আছেন কি না। সুপারভাইজারের কাছে গবেষণার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে যথাসময়ে কাজ শুরু করে দিতে পারেন। ভালো মানের রিসার্চ পাবলিকেশন করতে হলে গবেষণার শুরু থেকেই আপনাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দিতে হবে।

রিসার্চ টাইটেল
প্রথমত সুপারভাইজারের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন আপনি কোন বিষয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছুক এবং অবশ্যই সেই বিষয়ের ল্যাবরেটরির সুযোগ-সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ত্তাধীন থাকতে হবে।

লিটারেচার সার্ভে
আপনার গবেষণার প্রথম পদক্ষেপ হবে লিটারেচার রিভিউ করা, অর্থাৎ যে ফিল্ডে কাজ করতে চান ওই বিষয়ে পূর্বে কী কী কাজ হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। এ ক্ষেত্রে আপনাকে প্রচুর জার্নাল পেপার পড়তে হবে। ইন্টারনেটে খুঁজে বেড়ান রিলেটেড জার্নাল পেপারগুলোতে এবং যেগুলো ফ্রি অ্যাভেইলেবল নয়, পরিচিত কেউ উচ্চশিক্ষায় বিদেশে অধ্যয়নরত থাকলে তাঁকে অনুরোধ করুন আপনাকে ডাউনলোড করে দিতে। প্রতিটি পেপার পড়ার পর নিজের মতো করে রিভিউ লিখে ফেলুন।

কীভাবে রিভিউ লিখতে হয়, এমন অনেক উদাহরণ পেয়ে যাবেন ওই পেপারগুলো থেকেই। এরপর খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন এই ফিল্ডের রিসার্চ গ্যাপগুলো কী কী এবং প্ল্যান করে ফেলুন ওই নির্দিষ্ট এরিয়াতে আপনি কীভাবে অবদান রাখতে পারেন। এখানে আপনাকে বর্ণনা করতে হবে এই ফিল্ডে আপনার গবেষণাটি কেন দরকার এবং সেটাই হবে আপনার রিসার্চের মোটিভেশন।

মেথডলজি
এই অংশে আপনার রিসার্চের মেথডলজি/ পদ্ধতি বর্ণনা করতে হবে। আপনার রিসার্চ মেথডলজি হতে পারে এক্সপেরিমেন্টাল, এনালাইটিক্যাল/ নিউম্যারিক্যাল অথবা থিউরিটিক্যাল এবং এই টেকনিকগুলো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির আয়ত্তাধীন থাকবে।

রেজাল্ট বিশ্লেষণ ও আলোচনা
আপনার রিসার্চের রেজাল্টগুলো যথাযথ বিশ্লেষণ এবং এর পক্ষে যুক্তি স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি রেজাল্টের অর্ডার একটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ রেখে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। আপনার ফলাফলের সঙ্গে অবশ্যই পূর্বের রিলেটেড রিসার্চ পেপারের কম্পারিজন করতে হবে। এই কম্পারিজন আপনার বর্তমান রিসার্চ মেথডলজিকে ভ্যালিডেইট/ আইনসিদ্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো মানের জার্নাল পেপার বিস্তারিত আলোচনাসহ সাইট করা উচিত। এরপর আপনার ফলাফলের অন্তর্নিহিত মৌলিক বা তত্ত্বগুলো যুক্তিযুক্তসহ বিস্তারিত উপস্থাপন করতে হবে।

পরবর্তী ধাপে আপনার ফলাফলের ইমপ্লিকেশন যেমন থিউরিটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট, মডেলিং ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। এই বিষয়গুলোই প্রমাণ করে দেবে আপনার গবেষণার ফলাফল কতটা মানসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য।

শেষ:
এই অংশে আপনি গবেষণার মূল অনুসন্ধানগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করুন এবং এই গবেষণা নিয়ে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো ও এর সীমাবদ্ধতাগুলো নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরুন। এই সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে কাজ করবেন, সেটা গুছিয়ে লিখুন এবং আগ্রহী গবেষকদের একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা দিন।

আপনার উপস্থাপনা, পদ্ধতি, রেজাল্ট, আলোচনাসহ অন্যান্য অংশ যৌক্তিক, নিয়মতান্ত্রিক এবং বিশ্বাসযোগ্য হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এবার আপনি আপনার সম্পূর্ণ গবেষণার অ্যাবস্ট্রাক্ট খুব সহজেই লিখে ফেলতে পারবেন। সবশেষে আপনার রিসার্চ টাইটেল প্রয়োজন সাপেক্ষে পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন, যেখানে টাইটেলটি আপনার গবেষণার বিষয় ও স্কোপ নির্ভুলভাবে ইন্ডিকেট করবে। এই বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিলে ভালো মানের রিসার্চ পাবলিকেশন অনেকটা সহজ হয়ে যাবে আপনার জন্য।

লেখক:
*এস এম আরিফুজ্জামান, পিএইচডি গবেষক, ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]
*ড. মো. সাখাওয়াত খান, গবেষক, মনাশ ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]