ক্যামেরা তৈরিতে জাপান বিশ্বসেরা কেন

ক্যামেরা কেনার বেলায় জাপানি ব্র্যান্ডগুলো মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকেপেকজেলস

বিশ্বের সেরা ১০ ক্যামেরা ব্র্যান্ডের নাম বলুন। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতাম ক্যানন, নাইকন, সনি, ফুজিফিল্ম, অলিম্পাস, পেনট্যাক্স, প্যানাসনিক, লাইকা, কোডাক ও হ্যাসেলব্লাড। কেউ কেউ টুকটাক দ্বিমত করতে পারেন। তবে শীর্ষ দশে অন্তত ছয়টা জাপানি ব্র্যান্ড না রেখে কি কেউ তালিকা করতে পারবেন? দেখুন তো চেষ্টা করে।

জাপানিরা এমনিতেই ‘পারফেকশনিস্ট’। কেউ কেউ তো তাঁদের আদর করে পাগল ডাকেন, গোঁড়া বলেন। নিখুঁত না করে নাকি কিছুই বানাতে পারেন না তাঁরা। আর সে ব্যাপারে দ্বিমত করার সুযোগ জাপানিরা রাখেওনি। সেই পারফেকশনিস্টরা ক্যামেরা বানালে যে সেটা সেরা হবে, তেমনটাই তো স্বাভাবিক।

তবে ওয়েব ঘেঁটে যা বুঝলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ছবি তোলার যন্ত্রপাতি তৈরিতে ‘পরাশক্তি’ ছিল জার্মানি। জাপানিরাও সে সময় ক্যামেরা বানাত। তবে সে প্রতিষ্ঠানগুলো জাপানের বাইরে তেমন পরিচিত ছিল না। আর ক্যামেরা তৈরিতে জার্মানদের আধিপত্যে কেউ ভাগ বসাতে পারে, তা ছিল কল্পনাতীত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাহলে কী এমন হলো?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ‘টার্নিং পয়েন্ট’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নাগাদ জার্মানির ক্যামেরা তৈরি শিল্প মোটামুটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কারণ, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল জার্মানির পূর্বাঞ্চলে। যুদ্ধে এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে রাশিয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রুশরা লেন্স তৈরির প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী এমন হলো?
পেকজেলস

একই যুদ্ধে জাপানের শিল্প খাতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে নাইকন, ক্যানন এবং আসাহির (পরবর্তী সময়ে ‘পেনট্যাক্স’) মতো কিছু ছোট ক্যামেরা নির্মাতা পুনরায় দাঁড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির জোরে রপ্তানি শুরুর পাশাপাশি বেশ কিছু সুবিধা পায় জাপান।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, জার্মানির লাইকার প্রযুক্তি সরাসরি নকল করে ক্যানন। নাইকনও লাইকা ও কনট্যাক্সের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আর জার্মান প্রযুক্তিতে ভর করে সিঙ্গেল-লেন্স রিফ্লেক্স (এসএলআর) ক্যামেরা তৈরির পথে হাঁটে আসাহি অপটিক্যাল কোম্পানি।

জাপানের ক্যামেরা তৈরি শিল্প পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি পায় ১৯৫১ সালে। সে সময় লাইফ সাময়িকীর আলোকচিত্রীরা তাঁদের জিস কন্টাক্স ক্যামেরার জন্য জাপান থেকে নাইকনের লেন্স কেনেন। ছবিগুলো এত নিখুঁত আসে যে এর কারিগরি দিক তাঁদের অবাক করে দেয়। সে থেকে নাইকনের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

যুদ্ধাস্ত্রের প্রযুক্তি ক্যামেরায়

নানা অনলাইন ফোরামে আরেকটি বিষয় পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অপটিকস (লেন্সে ব্যবহৃত কাচ) মূলত সামরিক বিষয় ছিল। জাপান অপটিকসে বিশাল বিনিয়োগ করে।

সে সময় নিপ্পন কোগাকু (পরবর্তী সময়ে ‘নাইকন’) সামরিক অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল। জাপানি যুদ্ধজাহাজ ইয়ামাতোর জন্য ভিজ্যুয়াল এইড ডিভাইস বানাত তারা। বৈদ্যুতিক রাডার না থাকায় শত্রু খোঁজার সেটিই ছিল মৌলিক কৌশল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রবাহিনীর অন্য দেশগুলোর রাডার থাকায় অপটিকসে খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল না। যুদ্ধ শেষ হলে ক্যামেরা তৈরির অনুমতি পায় নাইকন।

ক্যামেরা তৈরিতে জাপান বিশ্বসেরা
পেকজেলস

অপটিক্যাল প্রযুক্তিতে জাপান এমনিতেই এগিয়ে ছিল। সেই দক্ষতা তারা ক্যামেরা তৈরিতে কাজে লাগায়। পাশাপাশি যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে শ্রমিকের মজুরিও কম ছিল। সব মিলিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে যায় জাপান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপানের ক্যামেরা তৈরি শিল্পের জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল। আর ক্যানন-নাইকনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানেই থেমে থাকেনি। ক্রমাগত উদ্ভাবন ও উন্নয়নের পথে হাঁটার চেষ্টা করেছে। মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। আর সে কারণেই ক্যামেরা তৈরিতে জাপান বিশ্বের শীর্ষে।