কী করে বলি, ‘আমিই সব্যসাচী’!

ভারতীয় বাঙালি ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জির খ্যাতি আছে সারা বিশ্বে। বাঙালি ফ্যাশন ধারাকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এই ডিজাইনারের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশে। এখনো বিভিন্ন সাক্ষাৎকার আর বক্তৃতায় সব্যসাচী বাংলার ঐতিহ্যকে কীভাবে ধারণ করছেন, সেসব বলেন। পড়ুন তাঁর কিছু বক্তব্য ও সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ।

সব্যসাচী মুখার্জি
ছবি: সংগৃহীত

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়

সেদিন ভীষণ বৃষ্টি ছিল। আমি মাত্র বিমানবন্দর থেকে আমার শোরুমে এসেছি। ফ্লাইট থেকে নামার পর শুনলাম, আমার লাগেজ এখনো এসে পৌঁছায়নি। মানিব্যাগ ছিল লাগেজের ভেতর। মন–মেজাজ খারাপ করে শোরুমে এসেছিলাম কাউন্টার থেকে কিছু টাকা নেব বলে। আমার পায়ে ছিল হাওয়াই চপ্পল। বৃষ্টিতে একদম কাঁদা–মাখামাখি অবস্থা। শোরুমে ঢুকতেই দেখি, এক বিদেশি লোক মন দিয়ে আমার কালেকশন দেখছেন। ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইনি কে?’ ক্যাশিয়ার বললেন, ‘নামটা তো বলেননি। শুধু বলেছেন, উনি প্যারিস থেকে এসেছেন, জুতা ডিজাইন করেন।’

খেয়াল করে দেখলাম, তিনি বিশ্বখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান লুবুটো! সেদিন যেই অবস্থায় ছিলাম, তাতে করে আমি তাঁর সামনে যেতে চাইনি। কিন্তু বের হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ক্রিশ্চিয়ান আমাকে দেখে ফেললেন। কাছে এসে বললেন, ‘শোরুমটা বেশ সুন্দর, কালেকশনগুলোও। আচ্ছা, মিস্টার সব্যসাচীকে কোথায় পাওয়া যাবে জানেন?’ আমারে পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, এ অবস্থায় কী করে বলি, ‘আমিই সব্যসাচী।’ মনে হচ্ছিল, বানিয়ে কিছু একটা বলে দিই।

আমারে পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, এ অবস্থায় কী করে বলি, ‘আমিই সব্যসাচী।’ মনে হচ্ছিল, বানিয়ে কিছু একটা বলে দিই।

শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, ‘আমিই সব্যসাচী।’ সঙ্গে সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ান আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেন। এরপর আমরা লম্বা সময় আড্ডা দিলাম। শ্রীদেবী, বলিউডের সিনেমা থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিয়ে কথা হলো। কিন্তু জুতা কিংবা পোশাকের ডিজাইন নিয়ে কোনো আলাপ আমরা করিনি। বিদায়বেলায় ক্রিশ্চিয়ান মৃদুস্বরে শুধু বললেন, ‘আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারলে ভালোই হয়।’

গল্পটা বলার কারণ হলো, অনেকেই মনে করেন, আমার খুব নাক উঁচু। কারণ, আমি কখনো কোনো ক্রেতা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করি না। আমাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি মনে করি, কাজের তাড়না থাকলে এবং আগ্রহ ও প্যাশনের জায়গা মিলে গেলে আমাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। সৃজনশীলতা আমাকে টানে, তাই সৃজনশীল আইডিয়া আর মানুষদের আমি কখনো এড়াতে পারি না।

সৃজনশীলতার উৎস যখন শৈশব

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ছোট্ট এক শহর চন্দননগরে আমার বেড়ে ওঠা। নিজেরা নৌকা চালিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে রবীন্দ্রসংগীতের রেওয়াজ করতাম। প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে ওঠা আর সংস্কৃতির চর্চা ছিল আমাদের রোজকার রুটিনের অংশ। আমাদের পাড়ায় একটাই সিনেমা হল ছিল। রাতের শো দেখতে গেলে যখন জোয়ারের সময় হতো, থিয়েটারের ভেতর পানি ঢুকে যেত। আমরা হাতে জুতা নিয়ে চেয়ারে পা তুলে সিনেমা দেখতাম। আমার ছেলেবেলা ছিল সিনেমা প্যারাদিসো ছবিটার মতো সুন্দর। এখন পর্যন্ত আমি যে কাজগুলো করে যাচ্ছি, তার প্রতিটাতেই আমার সেই ছেলেবেলার স্মৃতি, ওই সময় দেখা আমার মা-দিদিমাদের সৌন্দর্য আর প্রকৃতির অনুপ্রেরণা আছে। আমার সৃজনশীলতার মূল উৎসই আমার ছেলেবেলা, আমার শৈশবের গ্রাম।

ভারতীয় বাঙালি ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের নকশা করা টকটকে লাল লেহেঙ্গায় বউ সেজেছেন মিম।
ছবি: সংগৃহীত

আত্মহত্যা ও অবসাদ

চন্দননগর আমার এতটাই প্রিয় ছিল, আমি এতটাই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম যে জায়গাটা ছেড়ে আসা আমার জীবনের কঠিনতম অধ্যায় মনে হয়। আমার বাবা ওখানে এক জুট মিলে কাজ করতেন। যখন প্লাস্টিকের কদর বেড়ে যাওয়ায় পাটের চাহিদা কমতে শুরু করল, তখন বাবার জুটমিল বন্ধ হয়ে গেল। জীবিকার তাগিদে তিনি কলকাতায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিবারসহ আমরা যখন কলকাতায় আসি, তখন ভীষণ অবসাদে ভুগছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমাকে শেকড় থেকে উপড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমি নিজের ছোট্ট শহর ছেড়ে ভিনদেশে চলে যাচ্ছি। ওই সময় আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলাম। কৈশোরের সময়টা ভীষণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কেটেছে। যেবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম, অজ্ঞান ছিলাম। তখন মা আমাকে চড় মেরে হুঁশ ফিরিয়ে এনেছিলেন।

কখনো চুলের রং কমলা করে ফেলতাম, কখনো ছেঁড়া জিনসে সেফটিপিন লাগিয়ে ম্যাডোনার মতো স্টাইল করে প্যান্ট পরতাম। নিজেকে ভালো রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হতো।

সাত বছর সময় লেগেছিল মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে। ওই সময় কেউই মানসিক রোগের ব্যাপারে এত সচেতন ছিল না। নিজেকে ভালো রাখতে, অবসাদকে দূরে রাখতে আমাকে নানা ধরনের কায়দা–কৌশল কাজে লাগাতে হতো। কখনো চুলের রং কমলা করে ফেলতাম, কখনো ছেঁড়া জিনসে সেফটিপিন লাগিয়ে ম্যাডোনার মতো স্টাইল করে প্যান্ট পরতাম। নিজেকে ভালো রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হতো। বর্তমান সময়ে মানুষ অনেক বেশি সজাগ হচ্ছে এসব বিষয়ে। পরিবার এগিয়ে আসছে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলছে। বিষয়টি স্বস্তিদায়ক।

আরামপ্রিয় বাঙালি যেখানে সেরা

বাঙালিরা আরামপ্রিয় হয়। কাঁথা আর একটুখানি আরাম পেলেই বিছানা ছাড়তে চায় না। বাড়িতে ফেরাটা তাদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। তবে বাঙালিদের যদি পছন্দের কাজটা করতে দেওয়া হয়, তাহলে সেখানে তাদের চেয়ে সেরা আর কেউ হতে পারে না। পোশাক নকশা করাটা আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। তাই দিনের পর দিন নিরলসভাবে কাজ করে যেতে কষ্ট হয় না। আমার এ আগ্রহের আরেকটা কারণ আছে।

চন্দননগর শুধু আমার প্রিয় শহর ছিল না। আমার বাবারও প্রিয় ছিল। দিদিমা তাঁর চার সন্তান নিয়ে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছিলেন। তিনি একা তাঁর সন্তানদের বড় করেছেন। চন্দননগরে আমার বাবারও বেড়ে ওঠা। পাটকল থেকে চাকরি হারিয়ে বাবা রাতদিন আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু চাকরি খুঁজে পাওয়া যে কতটা কঠিন, বাবার সংগ্রাম দেখে ওই সময় আমি বুঝেছিলাম।

একটা যন্ত্র দিয়ে যদি ১০ জনের কাজ একবারে হয়, আমার কথা হলো একটা যন্ত্রের বদলে আমি ১০ জন লোককেই বেছে নেব। তাই তো এখন সব্যসাচী ব্র্যান্ডের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে চার হাজার কর্মী, শ্রমিক, কারুশিল্পী কাজ করছেন।

তখন থেকেই লক্ষ্য ছিল, যে কাজই করি না কেন, যত বেশি সম্ভব মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করব। তাই এখন আমার ফ্যাক্টরিতে আমি প্রতিবছর আগের বছরের চেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগের চেষ্টা করি। আমার প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব হলো প্রতিবছর কর্মসংস্থানের সুযোগ ২০ শতাংশ বাড়ানো। একটা যন্ত্র দিয়ে যদি ১০ জনের কাজ একবারে হয়, আমার কথা হলো একটা যন্ত্রের বদলে আমি ১০ জন লোককেই বেছে নেব। তাই তো এখন সব্যসাচী ব্র্যান্ডের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে চার হাজার কর্মী, শ্রমিক, কারুশিল্পী কাজ করছেন। আর ভারতব্যাপী আমাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৩৫ হাজার। আমি দাতব্য কাজ করি না, কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিই, যেন ওই কর্মজীবী মানুষেরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দাতব্য কাজ করার সুযোগ পান।

আমার বাবা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী ছিলেন, আর আমার মা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। আমি যেমন দারিদ্র্যের টানাপোড়েন দেখেছি, আবার মায়ের আভিজাত্যও আমাকে মুগ্ধ করেছে। মোট কথা, সচ্ছলতা আর সংগ্রামের ভারসাম্যই আমাকে আজকের পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে।

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভ, অ্যালজেব্রা কনভারসেশনস, টেলিগ্রাফ ও হিন্দুস্তান টাইমস