গুগলের সিইওর কাছে সোমবার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

অ্যালফাবেট ইনক্‌ ও তার অধীনস্থ সংস্থা গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুন্দর পিচাই। সম্প্রতি মার্কিন পত্রিকা দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর দৈনন্দিন চর্চা, অভ্যাস, আরও নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। কীভাবে সাজিয়েছেন তাঁর সাপ্তাহিক রুটিন? যেভাবে কাজ করেন গুগলের সিইও যেভাবে সপ্তাহের শুরু

সুন্দর পিচাই
ছবি: সংগৃহীত

সোমবার (সপ্তাহের শুরু) সকালটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় আমি সেই জরুরি বিষয়গুলো খুঁজে বের করি, যেগুলো নিয়ে আমাকে পুরো সপ্তাহ কাজ করতে হবে। কলম আর নোট খাতা নিয়ে বসে তিন থেকে পাঁচটি বিষয় লিখে ফেলি। এতে পুরো সপ্তাহের জন্য কাজগুলো গুছিয়ে ফেলা যায়। জরুরি কাজ বলতে চার-পাঁচটি বিষয়ই থাকে। ওগুলো মাথাতেই গেঁথে যায়। তবু শুক্রবার (সপ্তাহের শেষ ভাগে) আমি নোট খাতায় একবার চোখ বুলাই। দেখি—জরুরি কোনো বিষয়ে নজর দিতে ভুলে গেলাম কি না। ভুলে গেলে পরের সোমবার আবার সেটা নোট খাতায় টুকে রাখি। প্রতি সপ্তাহে এভাবেই নিজের কাজগুলো, জরুরি বিষয়গুলো একে একে গুছিয়ে নিই।

ছুটির দিনের অভ্যাস

মেডিটেশন চর্চাটা খুব দরকার। কিন্তু আমি এখনো সেই অভ্যাস করে উঠতে পারিনি। তবে আমার কাছে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। আমি যখন থেকে নিয়ম করে হাঁটা শুরু করলাম, তখন থেকেই উপলব্ধি করেছি, এ অভ্যাস কতটা উপকারী। হাঁটা আর দৌড়ানো—দুটিই আমার বেলায় বেশ কাজে দিয়েছে। মহামারির দিনগুলোতে আমি আমার কুকুরকে নিয়ে রোজ হাঁটতে যেতাম। হাঁটতে হাঁটতে পডকাস্ট শুনতাম। সেখান থেকে এনএসডিআর (নন-স্লিপ ডিপ রিলাক্সেশন) অডিও–ভিডিও ট্র্যাকের ব্যাপারে জানতে পারি।

দিনটা ছুটির হোক বা কাজের—সব সময় আমার মাথায় একসঙ্গে অনেক কিছু চলতে থাকে। ফলে মেডিটেশনের জন্য আমি কখনোই মনকে একদিকে নিবিষ্ট করতে পারি না। তাই যখনই সুযোগ পাই, মনকে স্থির করার জন্য আর চাপমুক্ত থাকার জন্য ইউটিউবে গিয়ে ১০-২০ মিনিট বা আধঘণ্টার এনএসডিআর ট্র্যাকগুলো শুনি। এটা অবশ্য শুধু ছুটির দিনে নয়, প্রায়ই করি।

নিয়মিত এ রুটিনের বাইরে ছুটির দিনে আলাদা করে ব্যায়ামের জন্য একটু সময় বের করি। শনি আর রোববার অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একটু বেশি সময় দিই শরীর আর মনের পেছনে। পুরো সপ্তাহ নিজেকে সক্রিয় রাখার জন্য এ সময়টুকু খুব জরুরি।

কাজে ফেরার ডাক

নতুন করে কাজে ফেরা নিয়ে আমি বেশ রোমাঞ্চিত। আমি মনে করি, সামনের দিনগুলোতে আমাদের কর্মক্ষেত্র হবে আগের চেয়ে অনেক বেশি নমনীয় (ফ্লেক্সিবল)। এই নতুন সময়কে আমি দেখছি একটি খালি ক্যানভাসের মতো করে। যে ক্যানভাসে আমরা মনের মতো করে আমাদের কর্মপরিকল্পনা এঁকে নিতে পারব। এ পরিকল্পনা আমাদের কর্মজীবনকে পরিপূর্ণ করবে, ব্যক্তিজীবনকেও করবে সহজ। ২০ বছর ধরে গুগল কর্মক্ষেত্রকে আনন্দময় আর উপভোগ্য করে তুলতে নানাভাবে নানা চেষ্টা করে এসেছে।

আমাদের ধারণা ছিল, কর্মক্ষেত্রে দিনের আনন্দময় সময়গুলো যত বেশি কাটানো যাবে, কাজের মধ্যে ততটাই সৃজনশীলতা ফুটে উঠবে। কয়েক দশক ধরে কর্মক্ষেত্র আর যাতায়াতেই কেটে যাচ্ছিল দিনের বড় অংশ। কিন্তু এখন একটু ভিন্নভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। নতুন স্বাভাবিকে আমরা বেশ কিছু প্রথাগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। আমরা দেখেছি, পরিশ্রমী, উদ্যমী আর লক্ষ্যনিবিষ্ট মানুষদের বেলায় একটু নমনীয় হলে, তাঁদের একটু নিজস্ব সময় কাটাতে দিলে তাঁরা আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে যান, কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবন—দুই ক্ষেত্রেই। আর কর্মীর এই এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো ফল পায় প্রতিষ্ঠান।

নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, একজন ব্যক্তিকে একান্তই নিজের মতো করে কাটানোর জন্য সপ্তাহের কয়েকটা দিন দেওয়া খুবই জরুরি। তাই আমরা নতুন স্বাভাবিকে নতুনভাবে সব শুরু করার জন্য সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করছি। আমাদের একদল কর্মী এখনো অফিসের বাইরে থেকে কাজ করবেন, আর আরেক দল সপ্তাহে তিন দিন অফিসে এসে কাজ করবে। তবে আমার মনে হয়, শুধু অফিসে আসার ঘোষণা এসেছে বলেই যে কাজে হাজির হতে হবে, এমনটা নয়। অফিসের এ সময়ে যদি কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রুপ মিটিং থাকে, কোনো মুখোমুখি আলোচনা থাকে, মগজ ঝালাইয়ের মতো বা কোনো গঠনমূলক কার্যক্রম থাকে, তবেই অফিসে উপস্থিতি অপরিহার্য হবে। প্রতিষ্ঠানের জন্যও সেই উপস্থিতি ফলপ্রসূ হবে। আমি নিশ্চিত, নতুন এ কাজের ধরনের সঙ্গে শিগগিরই আমরা সবাই খাপ খাইয়ে নেব।

দেখা-শোনা-পড়া

ইদানীং আমি নতুন কিছু শেখা আর কাজের ফাঁকে হালকা বিশ্রামের জন্য প্রচুর পডকাস্ট শুনছি। ইউটিউবে নানা ধরনের ভিডিও দেখছি। বেশির ভাগ সময় আমি শিক্ষণীয়, বড় দৈর্ঘ্যের ভিডিওগুলো দেখি। যেমন কিছুদিন আগে এমআরএনএ টেকনোলজির ব্যাপারে জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কারণ, ওই প্রযুক্তি নিয়ে জীবনে কোনো দিনও আমি কাজ করিনি, সামনে হয়তো করবও না, কিন্তু জেনে রাখার আগ্রহ হচ্ছিল।

আবার কোনো কোনো দিন পদার্থবিজ্ঞান বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নতুন কিছু জানতে খুব ইচ্ছা হয়। তখন চট করে সেই বিষয়ের কোনো ভিডিও দেখে ফেলি। সময়টা আমি ভীষণ উপভোগ করি। মোটকথা, আমার নিজের কাজের ক্ষেত্র বাদে অন্য আর যেকোনো সেক্টরের নতুন নতুন বিষয় জানার সুযোগ পেলেই আমার বেশ ভালো লাগে। এতেই আমার বিশ্রাম। ইদানীং মহাবিশ্বতত্ত্ব আর জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলো পড়ে বেশ মজা পাচ্ছি। খেলার প্রতিও আমার আগ্রহ আছে। কাজ আর বই পড়ার ফাঁকে সুযোগ পেলেই ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা দেখি। আর বাড়িতে ফিরে আমার স্ত্রী আর বাচ্চারা যা দেখতে ভালোবাসে, সবাই একসঙ্গে তা-ই দেখি। পরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকার, তাদের জানার এটাও একটা সুযোগ। তাই এ চর্চা নিয়ম করে চালিয়ে যাচ্ছি।

কখন নিজেকে কাজের মনে হয়

সিলিকন ভ্যালিতে আমার গুরু ছিলেন বিল ক্যাম্পবেল। সাবেক ফুটবল কোচ ও সফল এ উদ্যোক্তা ২০১৬ সালে মারা যান। আমি প্রতি সোমবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। প্রতিবার তিনি আমাকে একটা প্রশ্ন করতেন, ‘এ সপ্তাহে কী এমন টাইব্রেকার সিদ্ধান্ত নিলে?’ বড় প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে একজনকে প্রায়ই এমন পরিস্থিতে পড়তে হয়, যেখানে একদল এমন একটা মত দেবে, যেটার সঙ্গে নিজের মতকে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। দেখা যায়, দুই দলের দুটি মত দুই জায়গা থেকে যৌক্তিক। সেই ক্ষেত্রে ওই দ্বিধা দূর করার জন্য একজনকে এগিয়ে আসতে। এই ‘টাইব্রেকার’ সিদ্ধান্ত দেওয়াটা সব সময় সহজ হয় না। অনেক সময় একার কাঁধে অনেক ঝুঁকি নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। যখন তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাই, তখনই নিজেকে কাজের মনে হয়।