নেটফ্লিক্সের সিইও কেন ভিক্ষা করেছিলেন

বিশ্বখ্যাত ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক র‌্যানডলফ। নেটফ্লিক্স প্রতিষ্ঠার গল্প তিনি লিখেছেন দ্যাট উইল নেভার ওয়ার্ক–এ। বিনিয়োগ জোগাড় করা নিয়ে বইটিতে আছে মজার কিছু অভিজ্ঞতা। ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাঠকদের জন্য রইল কী করে বিনিয়োগকারীর কাছে টাকা চাইতে হয়, তার বয়ান।

মার্ক র‌্যানডলফ
ছবি: মার্ক র‌্যানডলফের ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
অন্যের পকেট থেকে পয়সা বের করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি।

ওপিএম। সিলিকন ভ্যালিতে খুব প্রচলিত শব্দ। ছোটবড় সব উদ্যোক্তার মুখেই কথাটা শোনা যায়। আপনাদের মনে কৌতূহল জাগতেই পারে, ভাবতে পারেন—এটার মানে কী! ওপিএম হলো ‘আদার পিপলস মানি’। অর্থাৎ ‘অন্য লোকের টাকা’। যখন সিলিকন ভ্যালির কোনো উদ্যোক্তার মুখে ‘ওপিএম’ কথাটা শুনবেন, বুঝে নেবেন তাঁরা বলতে চাইছেন—নতুন উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বপ্নটা নিজের হলেও বিনিয়োগ অন্যের হবে। কারণ উদ্যোক্তা হওয়া সহজ নয়, ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই খেয়াল রাখতে হবে—নিজের শ্রম, অধ্যবসায় আর স্বপ্নকে বাজি রেখে আপনি ঝুঁকি নিচ্ছেন। তাই বিনিয়োগের চাপটা অন্তত আরেকজনের ওপর দেওয়ার চেষ্টা তো করাই যায়। আর বিনিয়োগকারী মানে শুধু অর্থের জোগানদাতা নয়। দায়িত্ব, স্বপ্ন আর ঝুঁকি—সবই ভাগাভাগি করে নেওয়ার ক্ষেত্র।

বিনিয়োগ পাওয়ার আগের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা হলো বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করা। কারণ, অন্যের পকেট থেকে পয়সা বের করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। কোনো স্টার্টআপ শুরুর সময় আপনি যখন কারও কাছে বিনিয়োগ চাইতে যান এবং বিনিময়ে আপনার কাছে একটা আইডিয়া ছাড়া যখন আর কিছুই থাকে না, তখন পয়সা চাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। একবার ভেবে দেখুন তো, কেন একজন তৃতীয় ব্যক্তি শুধু আপনার মুখের কথার ওপর ভরসা করে তাঁর জীবনের সঞ্চয় আপনার হাতে তুলে দেবেন? কেন আপনার স্বপ্নের পেছনে নিজের কষ্টকে উৎসর্গ করবেন? কেন আপনার ওপর ঝুঁকি নেবেন?

কোনো স্টার্টআপ শুরুর সময় আপনি যখন কারও কাছে বিনিয়োগ চাইতে যান এবং বিনিময়ে আপনার কাছে একটা আইডিয়া ছাড়া যখন আর কিছুই থাকে না, তখন পয়সা চাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। একবার ভেবে দেখুন তো, কেন একজন তৃতীয় ব্যক্তি শুধু আপনার মুখের কথার ওপর ভরসা করে তাঁর জীবনের সঞ্চয় আপনার হাতে তুলে দেবেন?

কলেজে পড়ার সময় ন্যাশনাল আউটডোর লিডারশিপ স্কুলের ছয় মাসের একটা ওয়াইল্ডারনেস প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। উদ্যোক্তা হিসেবে আমার সাফল্যের পেছনে ওই প্রোগ্রামের অনেক অবদান ছিল। প্রোগ্রামে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে চোখ বেঁধে কোনো একটা অচেনা শহরে নিয়ে তিন দিনের জন্য ছেড়ে দেওয়া হতো। চ্যালেঞ্জটা হলো—নিজের চেষ্টায় তিন দিন অচেনা ওই শহরে টিকে থাকা। শুরুতে আমি ভেবেছিলাম, ‘এ আর এমন কী!’ কিন্তু ওই তিন দিনের প্রশিক্ষণে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, আরেকজনের কাছে পয়সা চাওয়া কত কঠিন।

আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চার্টার ওক নামের এক জায়গায়। তখন বিকেল পাঁচটা। আমার কাছ থেকে মানিব্যাগ, ঘড়ি আর অন্যান্য মূল্যবান জিনিস নিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় রাস্তায়। হাতের উল্টো পিঠে শুধু একটা ফোন নম্বর লিখে দেওয়া হয়েছিল। যদি কোনো বিপদ হয়, অথবা যদি আমি এই অ্যাডভেঞ্চার করতে না চাই, তাহলেই কেবল ওই নম্বরে ফোন করতে পারব। ছেলেবেলা থেকে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘোরাফেরার বদৌলতে আমি রাস্তাঘাট ভালো মনে রাখতে পারতাম। তাই অল্প সময়েই বের করে ফেলি চার্টার ওকের কোন দিকে বাজার, কোন দিকে খাবারের দোকান আর কোন দিকে পার্ক।

শুরুতে মজাই লাগছিল। দুপুরের খাবার একটু বেলা করে খেয়েছিলাম বলে রাতে খাওয়ার অত তাড়না ছিল না। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও বাড়তে শুরু করল। আমি ওই এলাকার একটা পার্কে গিয়ে কিছু পাতা আর গাছের ঝরে পড়া ডাল দিয়ে ঘাসের ওপর বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর অ্যাডভেঞ্চার আর অ্যাডভেঞ্চার থাকে না। ক্ষুধায় পেটে গুড়গুড় শুরু হয়ে যায়। আমি ওই এলাকার এক খাবার দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। গরম গরম পাউরুটি আর ধোঁয়া ওঠা কফির ঘ্রাণ ক্ষুধার যন্ত্রণাকে আরও তাতিয়ে দিল। কিন্তু পকেটে টাকা নেই, শহরের কাউকে চিনিও না, আবার সচ্ছল পরিবারের ছেলে হওয়ায় কখনো কারও কাছে হাতও পাতিনি। তাই ক্ষুধা নিবারণের অন্য পথ খোঁজা শুরু করলাম।

দেখলাম এক ব্যস্ত ভদ্রলোক তাড়াহুড়া করে আধ খাওয়া রুটি আর দুই চুমুক দেওয়া কফির কাপ রেস্তোরাঁর টেবিলে রেখেই উঠে চলে গেল। আমি লোকলজ্জার মাথা খেয়ে ওই আধখাওয়া খাবারের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিল, এইটুকু খাবার দিয়েই আজকের দিনটা পার করা যাবে। তাই মনের সুখে সারা দিন শহর ঘুরে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরতে লাগলাম। কিন্তু রাতে আবার সেই ক্ষুধার তাড়না। এবার আর কারও এঁটো খাবারে পেট ভরবে না। বুঝে গেলাম, টিকে থাকতে হলে আমাকে নিজের পয়সায় কিছু কিনে পেট ভরাতে হবে। কিন্তু অচেনা শহরে কে আমাকে টাকা দেবে? রাস্তার পাশের ডাস্টবিন থেকে একটা বাটি খুঁজে বের করলাম। এর পর রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঠিক করলাম, যে-ই আসবে, তাঁর কাছে টাকা চাইব।

এক ভদ্রলোক এলেন মোড়ে, ঠিক যখন টাকা চাইতে যাব, মুখের কথা কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। চাইতে পারলাম না! কারও কাছে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া এভাবে টাকা চাওয়া যে খুব কঠিন কাজ, প্রথম উপলব্ধি করলাম। এরপর কয়েকবার কয়েকজন এল, প্রতিবারই আমি ব্যর্থ হলাম। শেষমেশ এক ভদ্রমহিলা আমার সামনে এলেন। ক্ষুধায় তখন আমার চোখমুখ মলিন হয়ে গেছে। আর সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেললাম, ‘আপনার কাছে খুচরো পয়সা হবে? আমি খুব ক্ষুধার্ত।’ ব্যস এটুকুই। এই কথাটা দিয়েই আমি আমার আড়ষ্টতা ভেঙেছিলাম। যদিও ওই নারী আমাকে কিছু দেননি। কিন্তু এর পর থেকে খুব সাবলীলভাবে লোকের কাছে পয়সা চাইতে শুরু করলাম। বুঝে গেলাম, কী করে একজনের চোখের দিকে তাকাতে হয়, দৃষ্টি বিনিময়ের কোন পর্যায়ে শব্দবান ছুড়তে হয়, কণ্ঠে কতটা বিনয় আর কতটা আকুতি রাখতে হয়। এভাবে ওই রাতে ১ ডলার ৭৫ সেন্ট জোগাড় করে ফেললাম। পেটভরে খেলাম।

ক্ষুধার তীব্রতা আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছিল, আজও তা ভুলিনি। এখন কোনো বিনিয়োগকারীর কাছে গিয়ে আড়াই কোটি ডলার চাইতেও আমার সংকোচ হয় না। কারণ, আমি জানি, আমার প্রয়োজন কতটা। একজন উদ্যোক্তা তাঁর প্রয়োজন উপলব্ধি করেই বিনিয়োগ জোগাড়ের জন্য মাঠে নামেন। আর যখন একজন মানুষ আরেকজনের কষ্টের বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করে, তখন নিজের স্বপ্নের সঙ্গে আরেকজনের স্বপ্ন আর বিশ্বাসের দায়িত্বও কাঁধে চেপে বসে। তখনই একটি পরিকল্পনা, একটি উদ্যোগ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।