পিথাগোরাসের উপপাদ্য কি আসলেই পিথাগোরাসের আবিষ্কার | গণিত ইশকুল

গণিত অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি

পিথাগোরাসের উপপাদ্য
ছবিঃ vectorstock.com

কোনো সমকোণী ত্রিভুজের ভূমি ও লম্বের ওপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমষ্টি তার অতিভুজের ওপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমান—আমরা সাধারণত মাধ্যমিক জ্যামিতি বইয়ে গণিতের অন্যতম জনপ্রিয় ও সুন্দর এই পিথাগোরাসের উপপাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হই। এখন পর্যন্ত ৪০০টির বেশি ভিন্ন উপায়ে পিথাগোরাসের এ উপপাদ্য প্রমাণ করা হয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো, উপপাদ্যটির সঙ্গে পিথাগোরাসের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও তিনিই যে এটি প্রথম আবিষ্কার বা প্রমাণ করেছেন, এমন জোরালো কোনো প্রমাণ নেই। বরং ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষেরা পিথাগোরাসের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগেই এ উপপাদ্য প্রমাণ করেছিল বলে জানা যায়।

চলো, এবার আমরা পিথাগোরাস সম্পর্কে কিছুটা জেনে নিই।পিথাগোরাস একজন সংখ্যাপাগল ও জ্ঞানপ্রেমিক ব্যক্তি ছিলেন।তাঁর জন্ম গ্রিসের স্যামোস দ্বীপে হলেও তিনি জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে মিসর, ব্যাবিলন, ইতালিসহ অনেক দেশে ভ্রমণ করেন।তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সংখ্যাই এ মহাবিশ্বকে শাসন করে।বাস্তব জীবনের নানা রকমের বিষয়কে তিনি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করতেন।পিথাগোরাস গ্রিসে জ্ঞানচর্চার জন্য একটি দল তৈরি করেছিলেন, যাঁরা গণিত ও সংখ্যা নিয়ে কাজ করতেন।তবে তাঁদের জ্ঞানচর্চার এ কাজ চলত অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে।পিথাগোরাসের এ দল দেশ–বিদেশের গণিতের অনেক প্রমাণ সংকলন করেছিল।কিন্তু তারা এতই গোপনভাবে এগুলো সংরক্ষণ করত যে কোন তত্ত্বটি কে প্রমাণ করেছেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হতো না।দলটির অন্যতম একটি অর্জন ছিল ‘অমূলদ সংখ্যা’ সম্পর্কে জানা।সে সময় তারা বিশ্বাস করত, পূর্ণসংখ্যা ও তারভগ্নাংশ ব্যবহার করেই বাস্তব জগতের সবকিছু পরিমাপ করা সম্ভব।তবে একপর্যায়ে তারা তাদের জ্যামিতিক মেধা কাজে লাগিয়ে বুঝতে পেরেছিল, একটি বর্গক্ষেত্রের কর্ণের দৈর্ঘ্যকে কখনোই পূর্ণসংখ্যা বা তার ভগ্নাংশ আকারে লেখা সম্ভব নয়।এ উপলব্ধি তাদের বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।যেহেতু তারা অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্বকে স্বীকার করত না, তাই তারা বিষয়টি গোপন রাখে।

পিথাগোরাসের আবক্ষ মূর্তি

পিথাগোরাস ও তৎকালীন গ্রিসের জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে গণিত অলিম্পিয়াড একাডেমিক কাউন্সিলর চমক হাসানের ‘গণিতের রঙ্গে–৯–ডিজে পিথাগোরাস’ ইউটিউব ভিডিওটি দেখতে পারো।

এবার আমরা জানব, চার হাজার বছর আগের আরেক প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে, যার নাম ‘ব্যাবিলনীয় সভ্যতা’। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ভৌগোলিক অবস্থান ছিল বর্তমান ইরাকে। তারা লেখার জন্য মাটির পাত্রের ওপর সুচালো পাথর দিয়ে লেখার পর তা আগুনে পুড়িয়ে স্থায়ী আকৃতি দান করত। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ব্যাবিলনীয় সভ্যতার এমন একটি পোড়ামাটির ফলকের ওপর একটি বর্গক্ষেত্র ও তার দুটি কর্ণ আঁকা রয়েছে।

ছবিতে বর্গের একটি বাহুর পাশে ও কর্ণের নিচে বেশ কিছু চিহ্ন রয়েছে, যা আসলে তাদের সংখ্যা প্রকাশের বিভিন্ন প্রতীক। এখানে জেনে রাখা ভালো, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষ কিন্তু আমাদের মতো 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে গণনা করত না। তারা ব্যবহার করত 60 ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি। তাদের এই 60 ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, বর্গটির বাহুর পাশে লেখা ছিল 30 এবং কর্ণের নিচে লেখা ছিল 1;24,51,10 ও 42;25,35 (এটি ব্যাবিলনীয় সংখ্যা লেখার বর্তমান পদ্ধতি। এখানে কমা চিহ্ন দিয়ে প্রতিটি অঙ্ককে এবং সেমিকোলন দিয়ে পূর্ণ অংশ ও ভগ্নাংশকে আলাদা করা হয়েছে)।

ব্যাবিলনীয় সংখ্যা লেখার একটি পদ্ধতি
ছবিঃ study.com

চলো, আমরা কর্ণের নিচে লেখা এ সংখ্যা দুটিকে 10 ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে রূপান্তর করি।

1+24/60+51/602+10/603 = 1.414213

42+25/60+35/602 = 42.4263

এখানে 1.414213 আসলে √2 এর ছয় দশমিক স্থান পর্যন্ত মান এবং 42.4263 হলো বর্গটির কর্ণের দৈর্ঘ্য, অর্থাৎ 30√2 এর মান।অর্থাৎ এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষেরা জানত, কোনো বর্গের কর্ণের দৈর্ঘ্য তার বাহুর দৈর্ঘের √2 গুণ হয়।আর এই √2 ছিল প্রথম ব্যবহৃত কোনো অমূলদ সংখ্যা।আর অবাক করা ব্যাপার হলো, তারা √2 এর মতো জটিল একটি মান প্রায় সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিল।সে যা–ই হোক, এখান থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়, সেখানকার মানুষেরা পিথাগোরাসের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে থেকেই পিথাগোরাসের উপপাদ্য সম্পর্কে জানত এবং তা ব্যবহার করত।

তাহলে তোমাদের মনে এখন এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি আসলে কীভাবে ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য’হিসেবে স্বীকৃতি পেল?

পিথাগোরাসের বই 'এলিমেন্টস'
ছবিঃ ourheritage.ac.nz

এর যথার্থ উত্তর হয়তো কখনো পাওয়া সম্ভব হবে না।

তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো পিথাগোরাস যেহেতু জ্ঞান আহরণে ব্যাবিলনে গিয়েছিলেন, তিনি সেখান থেকে এটি শিখে এসে গ্রিসের মানুষদের তা শেখান। এর মাধ্যমে এটি গ্রিসে পিথাগোরাসের উপপাদ্য হিসেবে পরিচিতি পায়। আবার পরবর্তীকালে গ্রিস থেকেই যখন প্রথম জ্যামিতির বই ‘এলিমেন্টস’ প্রকাশিত হয়, তখন তার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই সম্ভবত এটি হয়ে ওঠে ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য।’