শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বেহাল,পাস না করার কারণ বাল্যবিয়েও

এসএসসি পরীক্ষাফাইল ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিয়া আড়াইপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র দুজন; কিন্তু তাদের কেউই পাস করতে পারেনি। বিদ্যালয়টি টিনের প্রাচীরঘেরা একটি এল-আকৃতির টিনশেড ঘর। স্কুলের পাশের বাড়ির বাসিন্দা আজিজুল হক জানান, বিদ্যালয়ে তেমন কোনো ছাত্রছাত্রী নেই।

বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আলতাফ বেগ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া দুজনই ছাত্রী। তারা বিবাহিত। গতবার কেবল গণিতে ফেল করেছিল তারা। কিন্তু গত এক বছরে তারা কোনো ক্লাস করেনি।

বিদ্যালয়টি ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এমপিওভুক্ত নয়। শিক্ষক রয়েছেন ১১ জন। বিদ্যালয়টিতে শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে বলে শিক্ষকেরা দাবি করলেও স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন নিয়মিত স্কুলে আসা–যাওয়া করে মাত্র ১০-১২ জন শিক্ষার্থী। ২০২৩ সালে এসএসসিতে চারজন পরীক্ষা দিয়েও কেউ পাস করেনি। ২০২৪ সালে ছয়জনের মধ্যে পাস করেছিল চারজন।

প্রতিবছরই আমাদের বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো হয়। কিন্তু এবার আমাদের সব অর্জন শেষ। ১৭ জন ছাত্রীর মধ্যে বাল্যবিবাহ হয়েছে কমপক্ষে ১০ জন ছাত্রীর। এ ছাড়া তারা পাঠদানে অনিয়মিত ছিল। আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করিয়েছি। তবে দু-একটি কারণে ফেল করে না। ফেল করার অনেক কারণ আছে।
পুরাকাটা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসরাত জাহান

এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দেশের ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করতে পারেনি। এর মধ্যে ৮৬টি মাদ্রাসা ও ৪৮টি বিদ্যালয়। অথচ গত বছর এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫১। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার্থী ছিল হাতে গোনা। তবে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০ জন বা তার কিছু বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েও কেউ পাস করতে পারেনি।

শূন্য পাস করা বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৪টি, কুমিল্লায় ১টি, যশোরে ২টি, চট্টগ্রামে ১টি, বরিশালে ১৬টি, দিনাজপুরে ১৩টি, ময়মনসিংহে ১১টি বিদ্যালয় রয়েছে।

কমবেশি প্রতিবছরই কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করে না; কিন্তু এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায় না। এবার এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। শুধু শূন্য পাস নয়, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পাস করে, সেগুলোর বিষয়েও পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান

গত বৃহস্পতিবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এবার গড় পাসের হার ও ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ সবই কমেছে।

এবার সারা দেশে ৩০ হাজার ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে ৯৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষার্থী পাস করেছে। তবে গতবারের চেয়ে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৯৮৪ কমেছে। গতবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান ছিল ২ হাজার ৯৬৮টি।

এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দেশের ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করতে পারেনি। এর মধ্যে ৮৬টি মাদ্রাসা ও ৪৮টি বিদ্যালয়। অথচ গত বছর এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫১। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার্থী ছিল হাতে গোনা।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের শূন্য পাস করা একটি বিদ্যালয় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শ্রীপুর হাইস্কুল। এই বিদ্যালয় থেকে ২০ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করতে পারেনি। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীন নাঙ্গলকোটের ইসলামপুর হাইস্কুল থেকে ৩২ জন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন নড়াইল সদরের মুলদাইর তালতলা মাধ্যমিক গার্লস স্কুল থেকে মাত্র একজন পরীক্ষা দিয়েছিল, কিন্তু পাস করতে পারেনি। আবার বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কাছিয়াবুনিয়া আসমত আলী পণ্ডিত দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২৮ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেনি।

জানতে চাইলে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাবকমিটির সভাপতি এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত অবস্থা ও খারাপ ফলের কারণ খতিয়ে দেখা হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।

শূন্য পাস করা বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৪টি, কুমিল্লায় ১টি, যশোরে ২টি, চট্টগ্রামে ১টি, বরিশালে ১৬টি, দিনাজপুরে ১৩টি, ময়মনসিংহে ১১টি বিদ্যালয় রয়েছে।

বিয়ের প্রভাবও দায়ী

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জরিপ করেছিল ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। এতে দেখা গিয়েছিল, জরিপের আওতায় আসা অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন শূন্য পাস করা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও একটি বড় অংশ বিবাহিত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলের কালিয়া আড়াইপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দুই পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও এ চিত্রই দেখা গেছে।

বরগুনার সদর উপজেলার পুরাকাটা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর ১৭ জন ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল; কিন্তু সবাই ফেল করেছে।

পুরাকাটা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছরই আমাদের বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো হয়। কিন্তু এবার আমাদের সব অর্জন শেষ। ১৭ জন ছাত্রীর মধ্যে বাল্যবিবাহ হয়েছে কমপক্ষে ১০ জন ছাত্রীর। এ ছাড়া তারা পাঠদানে অনিয়মিত ছিল। আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করিয়েছি। তবে দু-একটি কারণে ফেল করে না। ফেল করার অনেক কারণ আছে।’

বিদ্যালয়টি ২০২২ সালে এমপিওভুক্ত হয়, মানে শিক্ষকেরা সরকার থেকে বেতন-ভাতা পান। এই বিদ্যালয়ে মোট আটজন শিক্ষক রয়েছেন। মোট শিক্ষার্থী ১৬০ জন।

শূন্য পাস করা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও একটি বড় অংশ বিবাহিত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলের কালিয়া আড়াইপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দুই পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও এ চিত্রই দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমবেশি প্রতিবছরই কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করে না; কিন্তু এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায় না। এবার এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। শুধু শূন্য পাস নয়, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পাস করে, সেগুলোর বিষয়েও পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্বে থাকা শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি, বরগুনা এবং প্রতিনিধি, সখীপুর টাঙ্গাইল)