স্কুলে দীর্ঘ ছুটির ফাঁদে পড়াশোনা শিকেয় ওঠে

বছরজুড়ে নানা রকম ছুটির পাশাপাশি এসএসসি-এইচএসসির পরীক্ষার সময় ক্লাস অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতরসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে টানা ৪০ দিন ছুটি শেষে ৯ এপ্রিল আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক শাখার ক্লাস শুরুর কথা ছিল; কিন্তু পরদিন শুরু হয়েছে এসএসসি পরীক্ষা, চলবে আগামী ১৩ মে পর্যন্ত। আশপাশের ছয়টি বিদ্যালয়ের কেন্দ্র পড়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর ফলে অন্যান্য শ্রেণির ক্লাস নিয়মিতভাবে নেওয়া যাচ্ছে না।

তবে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো.ছালাহ্ উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, যেদিন এসএসসি পরীক্ষা থাকে না, সেদিন মাধ্যমিক ও কলেজ শাখার ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঈদুল আজহার পর শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। তখনো পরীক্ষার কারণে ক্লাসের বিঘ্ন ঘটবে। পাবলিক পরীক্ষার কারণে এই অস্বাভাবিক ক্লাস বন্ধের সমস্যা কেবল আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজেই নয়, সারা দেশের হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই একই সমস্যা। পাবলিক পরীক্ষার বাইরে আরও নানা রকম ছুটি বা অনির্ধারিত বন্ধের কারণে বছরের বড় অংশজুড়ে ক্লাস হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিখন–ঘাটতি নিয়েও অনেক শিক্ষার্থী ওপরের ক্লাসে উঠছে, যা তার কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ছে।

এমনিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অর্জিত না হওয়ার অভিযোগ আছে। তার মধ্যে বছরের বড় অংশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই ক্ষতি বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়ছে। এখন কোচিং-প্রাইভেট অনেকটাই শিক্ষার অংশ হয়ে যাচ্ছে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শিক্ষকদের অনেকেই নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিয়ে কোচিং-প্রাইভেট পড়াচ্ছেন।

যদিও ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা’ অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। এমনকি শিক্ষকেরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারেও পড়াতে পারবেন না। তবে দিনে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। আর সরকার নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতরই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস করানো যাবে। এ জন্য কাউকে বাধ্য করা যাবে না। তবে বাস্তবে এই নীতিমালা তেমন মানা হয় না। সারা দেশে বহু শিক্ষক নীতিমালা উপেক্ষা করে প্রাইভেট ও কোচিংয়ে পড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে কোনো তদারকিও দেখা যায় না। এমন পরিস্থিতির কারণে শিক্ষায় বৈষম্যও বাড়ছে। যেসব শিক্ষার্থীদের পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা এগিয়ে থাকছে, বিপরীতে পিছিয়ে পড়ছে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা।

পাবলিক পরীক্ষার কারণে এই অস্বাভাবিক ক্লাস বন্ধের সমস্যা কেবল আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজেই নয়, সারা দেশের হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই একই সমস্যা।

বছরে কত সময় বন্ধ থাকে

পাবলিক পরীক্ষার সময় ক্লাস বন্ধ থাকলেও এটি আবার শিক্ষার বার্ষিক ছুটির তালিকায় ছুটি হিসেবে নেই। যেমন এ বছরের সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ছুটির তালিকায় এসএসসি পরীক্ষার কারণে হাজারো বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধের কথা নেই। এ বছরের ছুটির তালিকায় মোট ৭৬ দিন ছুটি রয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এই ছুটি আরও অনেক বেশি।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত ‘শিক্ষার হালচাল ও আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এক পরামর্শক সভায় গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান একটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। তাতে বছরের বেশির ভাগ সময় বিদ্যালয় বন্ধের চিত্র তুলে ধরা হয়। এই প্রবন্ধে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসের চিত্র তুলে ধরা হয়। এ সময়ে মোট দিবস ছিল ৪২৭টি। এর মধ্যে খোলা ছিল ১৪৮ দিন। বাকি ২৭৯ দিনই বন্ধ ছিল। ওই সময়ে কোন মাসে কত দিন খোলা ও বন্ধ ছিল তারও চিত্র তুলে ধলা হয়। যেমন ২০২৩ সালের আগস্টে মোট ৩১টি দিবসের মধ্যে ১৫ দিন বন্ধ ছিল। আবার গত বছরের জানুয়ারিতে ১৮ দিন বন্ধ ছিল। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১৪ দিন বন্ধ ছিল।

মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয় বন্ধের কারণে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। শিখন–ঘাটতি থাকে।

এ বছরের ছুটির তালিকায় মোট ৭৬ দিন ছুটি রয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এই ছুটি আরও অনেক বেশি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিককালে শিক্ষায় লম্বা ছুটির প্রভাব শুরু হয় ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশে টানা এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি। বন্ধের সময় সরকার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ও টিভিতে ক্লাস প্রচার করলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সেগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি। শ্রেণিকক্ষের বিকল্প কোনোটাই হতে পারে না। করোনার সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল স্বল্প পরিসরে। সব শ্রেণির ক্লাস সব দিন হচ্ছিল না; কিন্তু নতুন করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করে সরকার। প্রথম দফায় এই ছুটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ৬ ফেব্রুয়ারি; কিন্তু পরে তা আবার বাড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়।

এ পরিস্থিতিতে শিখন–ঘাটতি নিয়েই প্রতিবছর উপরের ক্লাসে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। ঠিকমতো ক্লাস–লেখাপড়া ছাড়া ওপরের ক্লাসে উঠলে পাবলিক পরীক্ষায় এই শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভালো ফল অর্জন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে যেদিন পরীক্ষা থাকবে না, সেদিন অন্যান্য শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিকল্প উপায় কী

পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ভবন নির্মাণের প্রস্তাব আছে অনেক দিন ধরেই। উপজেলা সদরে এসব ভবন নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হলেও তা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ছালাহ্ উদ্দীন মনে করেন, পাবলিক পরীক্ষার জন্য আলাদা কেন্দ্র হলে ভালো হতো। এসব কেন্দ্র পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাসহ শিক্ষার অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যাবে।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এসএসসি পরীক্ষা ফেব্রুয়ারিতে এবং এইচএসসি পরীক্ষা এপ্রিলে নেওয়ার একটি রেওয়াজ তৈরি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর ধারবাহিকতা থাকছে না। এটিও আরেকটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেহেতু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাবর্ষ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত; সে ক্ষেত্রে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বার্ষিক পরীক্ষার মতো  নভেম্বর–ডিসেম্বরে পরিকল্পিত রুটিন করে নেওয়া যায় কি না, সেই চিন্তা করার কথাও বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। 

এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে যেদিন পরীক্ষা থাকবে না, সেদিন অন্যান্য শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিক ছুটি বন্ধ করার জন্য বিকল্প উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন মনে হয় পরীক্ষাই কেবল কাজ, পড়াশোনার গুরুত্ব যেন কম। শিক্ষা বোর্ডের উদ্যোগে পাবলিক পরীক্ষার জন্য আলাদা কেন্দ্র করা বা পরীক্ষার সময় অন্য শ্রেণির ক্লাস বন্ধ হবে না, এমন বিকল্প উপায় বের করা উচিত। পাশাপাশি শিক্ষাবর্ষ পরিবর্তন করাসহ কিছু করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে।