দূরপ্রাচ্যের শিশুশিক্ষা কেমন

স্কুলে শিক্ষার্থীরা
ছবি: লেখক

১.

মাসখানেক আগের কথা। আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে আয়ান, আমার আর তৃষার (আমার স্ত্রী) একটা যুগল ছবি দেখে বলে উঠল,
–এখানে পাপ্পা আর মাম্মি।
একটু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, পাপ্পা, তখন আমি কোথায় ছিলাম?
মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আমি চুপ হয়ে গেলাম। পাশ থেকে তৃষা উত্তর দিল,
-তখন তুমি আল্লাহর কাছে ছিলে।
ছেলে কী বুঝল বুঝতে পারলাম না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার জিজ্ঞেস করল,
-ওহ, তারপর আল্লাহ তোমাদের কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিল?
-হ্যাঁ বাবা। আমরা আল্লাহর কাছে বলেছিলাম, আয়ানকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দাও, প্লিজ। তাই পাঠিয়ে দিল।
উত্তর শুনে এবার সে সন্তুষ্ট। চোখে-মুখের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট।

ওই দিনের পর থেকে আয়ান আমাদের পুরোনো ছবি দেখলেই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
-পাপ্পা, তখন তো আমি আল্লাহর কাছে ছিলাম। তারপর আল্লাহ আমাকে পাঠিয়ে দিল।
এতটুকুই ছিল আমাদের সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলের বাচ্চা জন্মদানের প্রক্রিয়ার জ্ঞান।

তবে গত সপ্তাহে ওর জগতে হঠাৎ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল। স্কুল থেকে মা দিবসের অনুষ্ঠানের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। ছেলেমেয়েরা পারফর্ম করবে। অতিথি হিসেবে থাকবে তাদের বাবা-মায়েরা। স্কুলে বেশ কিছু দিন ধরে অনুষ্ঠানের রিহার্সেল চলছে। মা দিবস, একসময়ের মাতৃতান্ত্রিক তাইওয়ানিজ সমাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রিহার্সেলের প্রথম দিনেই বোঝানো হয়েছে মায়ের গুরুত্ব। মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক। এ সম্পর্ক বোঝাতে গিয়েই তারা স্কুলের প্রতিটি শিশুকে দেখিয়েছে কীভাবে একজন মা পেটে সন্তান ধারণ করেন। তারপর কীভাবে পৃথিবীতে আসে। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে কীভাবে বড় হয়। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী ছেলেমেয়ের মাথায় যতটুকু নেওয়া সম্ভব, ঠিক ততটুকুই।

ছবি: লেখক

ওই দিন ওকে স্কুল থেকে আনতে গেলাম। সে খুব খুশি। হাসতে হাসতে আমাকে বলল,
-পাপ্পা, বেবিটা মাম্মির পেটের ভেতর ছিল। তারপর বেবিটা ওখানে বড় হয়ে গেল। মাম্মির পেটও বড় হয়ে গেল। তারপর বেবিটা মাম্মির পেট থেকে বের হয়ে এল। তারপর মাম মাম খেয়ে বেবিটা আরও বিগ বেবি হয়ে গেল।

(আয়ান মায়ের বুকের দুধকে মাম মাম বলে)
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-ওহ, তাই?
-হুম, ও তো বেবি। তাই ওর মাম্মির মাম মাম খায়।

আমি আর কিছু বললাম না। বাসায় এসে কৌতূহল নিয়ে স্কুলের ফেসবুক গ্রুপে ঢুকলাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ সেখানে বেশ কিছু ছবি শেয়ার দিয়েছে। ছবিতে দেখলাম, স্কুলের ছেলেমেয়েদের বাচ্চা জন্মের ধাপগুলোর দেখানো হচ্ছে। কখনো ছবি, আবার কখনো ভিডিও আকারে। ছোট ছেলেমেয়েদের সহজভাবে বোঝানো হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়া।

সন্তানসহ লেখক
ছবি: লেখক

স্কুল থেকে আসার পর আয়ান বুঝতে পেরেছে, মায়ের সঙ্গে ওর আসল সম্পর্ক। কীভাবে পৃথিবীতে এসেছে। তাতে মায়ের কী ভূমিকা। মায়ের কী ত্যাগ ইত্যাদি।

আমার নিজের কথা ভাবলাম। প্রথম কবে জেনেছিলাম? কার কাছে জেনেছিলাম? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্যই নয়। খুব সম্ভবত স্কুলের সহপাঠীদের কাছে। আমার কাছের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা প্রথম কীভাবে শিশু জন্মের প্রক্রিয়া জেনেছে? কেউ বলল হাইস্কুলে পড়ার সময়ে অন্য বন্ধুর কাছে। একজন বলল, তার চেয়ে বয়সে ছোট এক কাজিনের কাছ থেকে। ভেবে নিজেই অবাক হলাম। যে তথ্যগুলো এখানকার প্রিস্কুলের ছেলেমেয়েদের শেখানো হয়, হচ্ছে, তা এখনো আমাদের সমাজে একটি ট্যাবু। প্রাকৃতিক একটা বিষয় আসলেই কি কখনো গোপন ব্যাপার হতে পারে? সম্ভবত না। শালীনভাবেই আমাদের বাচ্চাদের আসল সত্য শেখানো উচিত। স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধির জন্যই এ শিক্ষা প্রয়োজন।

২.

আয়ানের স্কুলে একদিন শিখিয়েছে, কীভাবে গাছের লতাপাতা, ডাল, বীজ—এসব দিয়ে হরেক রকমের সুন্দর জিনিস তৈরি করা যায়। একদিন শিখিয়েছে কীভাবে গাছ লাগাতে হয়। গাছের যত্ন নিতে হয়। তারপর স্কুলের মাঠে সব বাচ্চাদের নিজের হাতে একটি করে গাছ লাগাতে দিয়েছে।

প্রথমে গাছের উপকারিতা দিয়ে শুরু। গাছ লাগানো দিয়ে শেষ। যথাযথভাবে হাতে-কলমে শেখানো যাকে বলে। এখানেই শেষ নয়; বিকেলে স্কুল থেকে আসার সময় হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে নিজের হাতে লাগানো গাছসহ ছোট্ট টব। সপ্তাহব্যাপী সময় নিয়ে পুরো ব্যাপার শেষ করল।

ছেলের গাছের জন্য আমাদের দক্ষিণমুখী ব্যালকনি বরাদ্দ করলাম। রাতের বেলায় ল্যাব থেকে বাসায় এসে দেখি আয়ান খুব উত্তেজিত। একটু পরপর গ্লাস ওপেন করে ব্যালকনিতে যাচ্ছে। কখনো তার মাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। কখনোবা আমাকে। আর মুখে বলছে,

–পাপ্পা-মাম্মি, গাছটিকে সেফ করতে হবে!

দেখলাম, সকাল-সন্ধ্যায় সে গাছে পানি দেয়। তার ছোট্ট নরম হাতে গাছের মাথায় (পাতায়) হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতন আদর করে। মাঝেমধ্যে পাপ্পি খাওয়ার চেষ্টাও চলে!

আহা, ছোট্ট গাছের জন্য কী মায়া!

ভাবি, ‘গাছের প্রতি মায়া’ নামক জিনিসটার বীজ তিন বছর বয়সী ছেলের মাথায় কত সুন্দর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। হয়তো বাকি জীবনে এই বীজ থেকে চারা গাছ হবে। সেখান থেকে হবে বিশাল মহিরুহ। এটাই সম্ভবত সুশিক্ষা।

৩.

অন্য একদিন আয়ানকে স্কুল থেকে আনতে গেলাম। আমাকে দেখে প্রচণ্ড খুশি। বেরোতে বেরোতে বলল,
-পাপ্পা, তোমার জন্য সারপ্রাইজ এনেছি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওকে, দেখাও।
ও বলল, না, বাসায় গিয়ে দেখাব।
বাসায় আসার পর খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ছোট খরগোশের রেপ্লিকাটি দিল। তারপর জিজ্ঞাসা করল,
-তুমি এখন খুশি হয়েছ?

আসলে, আজকে ওর স্কুলে শিখিয়েছে কীভাবে সারপ্রাইজ দেওয়ার মাধ্যমে কাউকে খুশি করতে হয়। ব্যাপারটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষক প্রথমে সব বাচ্চার হাতে একটি করে রঙিন ডিম দিয়েছিল। তারপর বলল, সেই ডিম ভাঙতে। ডিম ভাঙার পর বেরিয়ে এল একেক রকমের খেলনা। বাচ্চাদের মনোজগতে এই ছোট সারপ্রাইজ বিশাল এক ব্যাপার। স্কুলে হাতে-কলমে শিখেছে। বাসায় এসে সেই শিক্ষা আমার ওপরে প্রয়োগ করেছে। জাস্ট এতটুকুই। এখানে স্কুল থেকে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার একটি করে গল্পের বই দেওয়া হয়। বলা হয়েছে, যেন সব মা-বাবা এসব গল্প বাচ্চাদের পড়ে শোনায়। গল্প পড়তে গিয়ে আমি একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম। সব গল্পের কিছু কমন মোরাল আছে। আর তা হলো, বন্ধুত্ব, বন্ধুদের মধ্যে শেয়ারিং, একে অন্যের উপকার, বিপদে কেউ কাউকে ছেড়ে না যাওয়া ইত্যাদি। গল্পের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্মভাবে বাচ্চাদের মনের ভেতর পজিটিভিটি ঢুকিয়ে দেওয়ার কী সুন্দর চেষ্টা!

৪.

২০১৭ সালের কথা। দক্ষিণ কোরিয়ায় তখন শরৎকাল। ল্যাব বিল্ডিং থেকে অ্যানিমেল সেন্টারে যাওয়ার সময় আশপাশের গাছে লাল-হলুদ রঙের পাতা দেখছি। কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম হয়তো। হঠাৎ শুনি, কারা যেন বলছে,

–আন্নেয়ং হাসেয়ো, আন্নেয়ং হাসেয়ো।
এটা কোরিয়ান ভাষায় সম্মোধনসূচক বাক্য।

তাকিয়ে দেখি একদল ছোট ছেলেমেয়ে! বয়স কত আর হবে। তিন থেকে চারের ঘরে! আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা পাশ দিয়ে ‘আন্নেয়ং হাসেয়ো, আন্নেয়ং হাসেয়ো’ বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। সামনে, পেছনে আর মাঝখানে মোট তিনজন শিক্ষিকা। তাঁরা বাচ্চাদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। বড়দের সঙ্গে দেখা হলে কীভাবে সম্মান করতে হয়। কীভাবে হাসিমুখে সম্মোধন করতে হয়।

কোরিয়ায় দেখেছি পরিচিত–অপরিচিত সবাই মাথা নিচু করে ‘আন্নেয়ং হাসেয়ো’ অথবা কোরিয়ান সালাম দেয়। বড়দের আনকন্ডিশনাল সম্মান দেখায়। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, এই ব্যাপারগুলো ছোট বয়স থেকেই স্কুল ও পরিবার—দুটি জায়গাতেই হাতে–কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়।

জুনান থেকে টাইয়োয়ান সিটিতে যাচ্ছি। তিন দিনের টানা ছুটি হওয়ায় ট্রেনে খুব ভিড়। পাশের সিটে একটা বাচ্চা মেয়ে। একটু পরপর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সঙ্গে একটি বয়স্ক কাপল। বোঝাই যাচ্ছে, তাঁরা বাচ্চাটির দাদা-দাদি/নানা-নানি টাইপ কিছু একটা হবেন।

হাত দিয়ে হাই/হ্যালো বললাম। পাশের বয়স্ক লোকটি জানালেন,
-আমার নাতি তোমাকে ‘নি হাও’ বলেছে!

চাইনিজ ভাষায়, তুমি ভালো আছ? তবে একেও চাইনিজ কালচারে সালামের মতো ব্যবহার করা হয়।

তাইওয়ানিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ প্রিস্কুলগুলোয় মূলত বাচ্চাদের হাতে–কলমে ম্যানার বা সামাজিক আদবকায়দা, রীতিনীতি শেখানো হয়। কীভাবে ধন্যবাদ দেবে। কীভাবে বিদায় নিতে হবে। কীভাবে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে ‘হ্যালো’ বলতে হবে। এককথায়—সব।

সব জাতিই নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলে নিজস্ব সংস্কৃতি মাথায় রেখে। আমরা কি তা করছি? সম্ভবত না! কিন্ডারগার্টেন কিংবা স্কুলগুলোয় কখনো শেখানো হয় না কীভাবে বড়দের সম্মান দেখাতে হয়। স্কুলে বাচ্চাদের হাসিমুখে সালাম/আদাব/হ্যালো বলার শিক্ষা দেওয়ার দৃশ্য অন্ততপক্ষে আমার চোখে কখনো চোখে পড়েনি। একসময় পরিবার থেকে সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হতো। এ পারিবারিক শিক্ষার সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! আমাদের দেশে বলা হয়, আগেকার ছেলেমেয়েরা অনেক ভদ্র ছিল। বড়দের সম্মান করত। সালাম দিত। এখন নাকি যুগ বদলে গিয়েছে! আসলেই কি তা–ই? যুগ বদলে গিয়েছে, না আমরাই আমাদের ছোট ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি?


*লেখক: বদরুজ্জামান খোকন, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটস, তাইওয়ান

*দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]