অনলাইনে শিক্ষা ও শিশুর নিরাপত্তায় শিক্ষকের সচেতনতা

গত বছরের মার্চে কোভিড-১৯–এর কারণে বাংলাদেশেও যখন লকডাউন শুরু হয়, স্থবির হয়ে গিয়েছিল অর্থনীতি, ব্যবসায়, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব কার্যক্রম। ঘরে বন্দী থেকে মানুষ ভেবে পাচ্ছিল না কীভাবে আবার সব স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা যায়। বাইরে বেরোতে না পারলেও জীবন ও কাজকর্ম তো থেমে যেতে পারে না। তখন থেকেই মানুষ একটু বেশি করেই বুঝতে পেরেছিল ইন্টারনেট প্রযুক্তির সুবিধা। অনলাইনে চলছিল ব্যবসায়, অফিস, করপোরেট কার্যক্রম।

কোমলমতি শিশুদের পড়াশোনা ও শিক্ষা যেন অব্যাহত থাকে, তারই প্রচেষ্টায় স্কুলগুলোতেও চালু হয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতি। অনেক বছরের চলে আসা নিয়মের বাইরে হঠাৎ করে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার এই পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেশ হিমশিম খেতে হয় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও।

নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্লাস নিতে গিয়ে শিক্ষকদেরও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। শিক্ষকের দায়িত্ববোধ থেকে শুধু প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণেই থেমে যায়নি শিক্ষা বরং অনলাইনে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা যেন সঠিকভাবে ঠিক লাইনে চলতে পারে, সেই ব্যাপারেও সচেতনতা তৈরির জন্যেও কাজ করছেন। শিক্ষকই তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদভাবে ও সঠিক উপায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে শিক্ষা ও জ্ঞান দিতে পারেন।

একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রিন্সিপাল ফ্লোরা গমেজ বলেন, করোনার লকডাউন শুরু হওয়ার সময় থেকেই অনলাইনে ক্লাস শুরু করে দিয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সে জন্য অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না জেনে অনেকেই অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েছে আমরা শুনেছি, তাই আমরা অনলাইনের নিরাপত্তা এবং এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষকদের আরও বেশি সচেতন হতে বলেছি।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হাবিব বলেন, গত বছর মার্চের ১৭ তারিখে যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল, এরপর সরকার অনলাইনে ক্লাসের নির্দেশনা দিল। তখন আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি, কারণ আমরা কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলাম। কারণ বাংলাদেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা অগ্রসর ভূমিকা রেখে এসেছি এবং এসবই আসলে প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের সুবিধা। ভবিষ্যতেও ডিজিটালনির্ভর হবে সবকিছু।

প্রযুক্তিকে যেমন ভালো কাজে ব্যবহার করে সুফল ভোগ করা যায়, তেমনি অনেকে এর অপব্যবহার করে অন্যের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। আমাদের সচেতন হতে হবে এবং বেছে নিতে হবে ভালো পথটি। আর এর জন্য ইন্টারনেটের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। অনলাইনে চলাফেরার প্রাথমিক নিয়মগুলো যেমন পাসওয়ার্ড এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো নিরাপত্তার শীর্ষে থাকা উচিত।

এ জন্য অভিভাবকদেরও অনলাইন ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে পরিচিত করা এবং প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্বন্ধে জানাতে হবে।

প্রযুক্তি কীভাবে নিরাপদে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা একজন শিক্ষক তার শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারেন—
*স্কুলে অনলাইনে পড়াশোনার জন্য সঠিক নীতিমালা ও তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং নিয়মিতভাবে নীতিমালাগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে হবে।

*স্কুলের পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিশেষ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অনলাইন নিরাপত্তা শিক্ষার মধ্যে সামাজিক এবং সংবেদনশীল শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করাটাও খুব জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের অনুভূতিগুলোকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক উপায়ে ব্যবহার করতে পারবে, যা অনলাইন এবং অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করবে।

*শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক যেন নীতিমালা মেনে চলেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং নীতিমালা অবশ্যই সব বয়সী মানুষের কথা ভেবেই তৈরি করতে হবে।
*অনলাইনে নিরাপদ শিক্ষার জন্য স্কুল একজন অনলাইন নিরাপত্তা সমন্বয়কারী নিয়োগ করতে পারে, যিনি সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকবেন।

*স্কুলের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

*স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কমিটি এবং গভর্নিং বডির সব সদস্য অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

*স্কুলের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিতভাবে অডিটের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

*এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ডিভাইস ব্যবহার করলে সেটা যেন নিরাপদভাবে ব্যবহার করতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করে শেখাতে হবে।

শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে আইন বা অপরাধীর শাস্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একটি জাতিকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে, সচেতন ও শিক্ষিত করতে হলে শিশু বয়স থেকেই শিক্ষা ও নীতিবোধ গড়ে তুলতে হবে। তাই শিশুদের জন্য অনলাইনের নিরাপত্তাবিষয়ক সচেতনতার জন্য জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমে আলাদা অধ্যায় ও গ্রন্থ যুক্ত হওয়া দরকার।

তা ছাড়া শিশুদের এবং অভিভাবকদের ঠিক লাইনে ও অনলাইনে রাখতে অর্থাৎ সঠিক নিয়মে নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার শেখানোর উদ্দেশ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণফোন, টেলিনর গ্রুপ এবং ইউনিসেফ। চাইল্ড অনলাইন সেফটি কার্যক্রমের আওতায় ডিজিওয়ার্ল্ড (https://www.telenor.com/digiworld-en/)-এ কুইজ খেলার মাধ্যমে শেখা যাবে কী করে অনলাইনে নিরাপদে থাকা যায়। বিভিন্ন বয়সক্রম অনুযায়ী খেলাটি সফলভাবে শেষ করলে অংশগ্রহণকারী পাবে একটি অনলাইন সেফটি সার্টিফিকেট।