উপাচার্য ছাড়া ৩০ বিশ্ববিদ্যালয়

শীর্ষ তিনটি পদ ফাঁকা থাকায় প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন কাজে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও বেতনও আটকে গেছে।

রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই এক মাস ধরে। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭৭ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর গত মাসের বেতন আটকে গেছে। অন্যান্য কাজেও সমস্যা হচ্ছে। গত ১৪ আগস্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শীর্ষ তিন পদ শূন্য।

শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে বর্তমানে দেশের ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। আর সহ–উপাচার্য নেই ১০৭টিতে। উপাচার্য ও সহ–উপাচার্য না থাকলে কোষাধ্যক্ষকেও কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বর্তমানে অর্ধশতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষও নেই। শীর্ষ তিনটি পদ ফাঁকা থাকায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন কাজে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। উপাচার্য না থাকলে শিক্ষার্থীদের মূল সনদ পেতেও সমস্যায় পড়তে হয়।

বর্তমানে দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৬টি। অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৭টি, ৯টিতে এখনো শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়নি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তিনটিতে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭টিতে এখন উপাচার্যের পদ শূন্য। ২৩টি সরকারি ও ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ–উপাচার্য নেই।

উপাচার্য না থাকলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। শৃঙ্খলাও থাকে না। উপাচার্য, সহউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ। এসব পদ ফাঁকা রাখা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আরও দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। এর মধ্যে কুষ্টিয়ায় বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য হারুন উর রশীদ আসকারীর মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২১ আগস্ট। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোষাধ্যক্ষের পদও শূন্য। গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) বিদায়ী উপাচার্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৮ আগস্ট।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ এই পদগুলোর মেয়াদ কবে শেষ হয়, তা নির্দিষ্ট থাকে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত আগে থেকেই নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা, যাতে সময়মতো নিয়োগ দেওয়া যায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র দাবি করছে, তারা এসব পদ পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ১১ মাস পর ২ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এ কেউ এম মাহবুবকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এই দীর্ঘ ১১ মাস ধরে একজন অধ্যাপককে উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব দিয়ে রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রুটিন কাজের বাইরে কোনো কাজ হয়নি। এ কারণে তুলনামূলক এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক নিয়োগ থেমে আছে। আটকে আছে শতাধিক শিক্ষকের পদোন্নতি। এক বছরের বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে কাজ করা ১৫৩ জন কর্মচারী। এমন আরও কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পদ শূন্য থাকার বিষয়টি তাঁদের নজরে এসেছে। এগুলো দ্রুত পূরণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ফাঁকা পদ বেসরকারিতে বেশি

আইন অনুযায়ী, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ—এ তিন পদে নিয়োগ দেন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি। তবে প্রাথমিক কাজটি করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব আসার পর তারাই সরকারের কাছে এসব পদে নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। কিন্তু এই কাজে ঢিলেমি হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এই তিন পদে নিয়োগ দিতে একেকটি পদের বিপরীতে তিনজন অধ্যাপকের নাম প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেগুলোর ইউজিসির মাধ্যমে যাচাই করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ তিনটি পদই পূরণ আছে, এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা মাত্র ১০। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিন পদে নিয়োগ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষেরই দায় আছে। অভিযোগ আছে, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম পুরোপুরি না মেনে নিজেরাই একজনকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে মাসের পর মাস শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালায়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অর্জিত ডিগ্রির সনদে মূল স্বাক্ষরকারী হলেন উপাচার্য। কিন্তু বৈধ উপাচার্য না থাকায় মূল সনদ পেতে শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়। যদিও সাময়িক সনদ দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করা যায়। কিন্তু মূল সনদ দেওয়া যায় না।

ইউজিসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনুমোদিত ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শীর্ষ পদে নিয়োগের জন্য ৩২১ জন অধ্যাপকের প্রয়োজন। কিন্তু এত যোগ্য ও পছন্দ অনুযায়ী অধ্যাপক পাওয়া একটি সমস্যা। অভিযোগ আছে, আইন অমান্য করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে কাউকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়, যা আইনের পরিপন্থী। কারণ, রাষ্ট্রপতি ছাড়া এই তিন পদে আর কেউ নিয়োগ দিতে পারেন না।

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য নেই চার মাস ধরে। গত ২৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য জাতীয় অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী মারা যাওয়ার পর থেকেই এই পদ শূন্য আছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজনকে উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়েছে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার সারোয়ার রাজ্জাক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশও নিজেরা একজনকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, করোনার কারণে নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ পেতে একটু সময় লাগছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য রয়েছে, সেগুলোতে নিয়োগের জন্য নামের প্রস্তাব ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিতে বলা হয়েছিল। এরপর কেউ কেউ দিয়েছে, কেউ কেউ দেয়নি। আবার অনেক সময় অসামঞ্জস্য প্রস্তাব পাঠানোরও উদাহরণ আছে। যেমন, উপাচার্য না থাকা এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রস্তাবের বিষয়ে ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে জানিয়েছে, উপাচার্য নিয়োগের প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য এবং আরেকজনের বয়স ৭৮ বছরের ওপরে। এ জন্য তিনজনের বিকল্প প্রস্তাব দিতে বলেছে মন্ত্রণালয়।

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্যের নিয়োগ করা উপাচার্য নেই, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, শান্ত–মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, সিলেটের নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের একেকটি পদের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন তিনজনের নাম প্রস্তাব দিতে হয়। কিন্তু এত যোগ্য লোক পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তিনি বলেন, নিয়োগের যে প্র​ক্রিয়া, তাতে অনেক সময় তিন–চার মাস লেগে যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির উচিত এই প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা।

উপাচার্য না থাকলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চলতে পারেন না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য না থাকলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। শৃঙ্খলাও থাকে না। উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ। এসব পদ ফাঁকা রাখা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়।