এটি আসলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ: আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ
ফাইল ছবি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থাকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১২তম সিন্ডিকেট সভায় গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল ফজলকে বরখাস্ত, একই বিভাগের প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ‘উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগ আনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এর প্রতিবাদে আজ সকালে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সংবাদ সম্মেলনে যৌথভাবে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক আরাফাত রহমান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মানস চৌধুরী৷

সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আপাতদৃষ্টিতে দুজন শিক্ষার্থী বা তিনজন শিক্ষকের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আক্রমণ মনে হলেও এটি আসলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ মানেই দেশের সব নাগরিকের ওপর আক্রমণ। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আচরণ করতে না পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারেন, তাহলে সেটি আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দুর্নীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বৈরতন্ত্র ও নিপীড়নমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষক ও নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে একটি গণতদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে কী হচ্ছে, তার ওপর তদন্ত করে প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশ করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে শিক্ষকদের এই হেনস্তা করছেন। নিয়মতান্ত্রিকতা ও আইনের দোহাই দিয়ে প্রশাসন অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। কারণ, নির্যাতনের শিকার শিক্ষকদের একের পর এক কারণ দর্শানোর নোটিশ ও ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিলেও কোনো অভিযোগ বিবরণী তাঁদের সরবরাহ করেনি প্রশাসন। অভিযোগকারীরা নিজেরাই তাঁদের অপরাধ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানতে পারেননি। অথচ অভিযোগ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া অভিযুক্তের আইনানুগ অধিকার। চূড়ান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দেওয়ার জন্য তিনজন শিক্ষককে সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় কর্মদিবস। আইনত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ন্যূনতম সাত কর্মদিবস সময় দিতে হয় জবাব দেওয়ার জন্য।

শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ভূমিকা পূর্বপরিকল্পিত বলে পরিষ্কার হয়েছে। এসবের শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে কিছু শিক্ষকের সংহতি জানানোর মাধ্যমে। শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে আবাসনসংকট সমাধানের মতো দাবি ছিল। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যার সমাধান চায় না। সংহতি জানানো শিক্ষকেরা তখন থেকেই কর্তৃপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। কারণ, কর্তৃপক্ষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা বজায় রাখতে দিতে চায় না।

সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে চার দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শাস্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে; প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ সব অভিযোগের তদন্ত করতে হবে; অযোগ্য-দুর্নীতিবাজ উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনাবিধিতে গণতন্ত্রায়ণ ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ানোর ‘শাস্তি’ হিসেবে শিক্ষকদের ভয় দেখানো বন্ধ করতে হবে।
চার দফা দাবি আদায়ে আগামী বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী সব বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুর ১২টা থেকে একসঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক কাজী মারুফুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন।

এর আগে, গত বছরের ১ ও ২ জানুয়ারি পাঁচ দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। বেতন-ফি কমানো, আবাসনসংকটের সমাধানসহ পাঁচ দফা দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের। এর প্রায় ৯ মাস পর ১৩ অক্টোবর শিক্ষার্থীদের ‘উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগে ওই তিন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। ওই চিঠির জবাব দেওয়া হলে গত ৯ নভেম্বর আরেকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ২৩ নভেম্বরের ওই চিঠি জবাব দেওয়া হলে ২৪ নভেম্বর ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত ৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবারও চিঠি দিয়ে ১০ ডিসেম্বর হাজির হয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করার জন্য ওই তিন শিক্ষককে ডাকা হয়। পরে ১৩ ডিসেম্বর বিশেষ সিন্ডিকেট ডেকে আবারও তিনজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ১০ জানুয়ারি ওই চিঠির জবাব দেন শিক্ষকেরা। এরপর ১৮ জানুয়ারি সোমবার সিন্ডিকেট করে চূড়ান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় প্রশাসন।

গত মঙ্গলবার সকালে চাকরিচ্যুত ও অপসারণ করার আগে চূড়ান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ ওই তিন শিক্ষকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। ২১ জানুয়ারি বেলা দুইটার মধ্যে ওই চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছিল।