করোনা মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ছবি: আবদুস সালাম
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ছবি: আবদুস সালাম

ইতিহাস বলে, যেকোনো দুর্যোগে, বিপর্যয়ে নিজেদের জায়গা থেকে সব সময় এগিয়ে এসেছেন শিক্ষার্থীরা, তরুণেরা। এবারও ফেসবুকের হোম পেজে যখন করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত নানা ভয়াবহ তথ্য ভেসে উঠছে, তখন আশা জাগিয়েছে শিক্ষার্থীদের কিছু উদ্যোগের ছবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করেছেন। এ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছিলাম আমরা।

নিজেদের ল্যাবে কাজ করছেন বুটেক্সের শিক্ষার্থীরা
নিজেদের ল্যাবে কাজ করছেন বুটেক্সের শিক্ষার্থীরা

ল্যাবে তৈরি স্যানিটাইজার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াহেদুজ্জামান তুহিন জানান, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে তাঁরা ৮-১০ জন শিক্ষার্থী মিলে কাজ শুরু করেন ১৪ মার্চ। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত তাঁদের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। 

প্রথমে তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক বোতল নমুনা তৈরি করেন। এতে তাঁদের সহযোগিতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মাহতাবউদ্দিন। পরীক্ষামূলকভাবে নমুনা প্রস্তুতিতে সফল হন তাঁরা। ফলে আরও বড় পরিসরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এরপর কাঁচামাল সংগ্রহ করে টানা কর্মযজ্ঞ শুরু করেন ফার্মেসি বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তিন দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা কাজ করে গেছেন তাঁরা। তৈরি করেছেন প্রায় ৭৫ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এ ছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে ২০০ মিলিলিটার করে ১০ বোতল লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ প্রস্তুত করেছেন তাঁরা। 

অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা সাবান তৈরির পেছনে আমাদের কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। বরং আমরা প্রথমেই এগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছি।’ 

তবে শুধু নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরাও। ১১ মার্চ থেকে শিক্ষার্থীরা কাজে নেমেছিলেন। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান জাকির বলেন, ‘১৬ মার্চ রাত তিনটা পর্যন্ত আমরা কাজ করেছি। অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি করেছি প্রায় এক হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সেগুলো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।’ এদিকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতকরণের যাবতীয় খরচ বহন করেছেন বুটেক্সের প্রাক্তন ছাত্র সাজেদুর রহমান।

এমনই মহৎ আরেকটি উদ্যোগেও আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ফোরাম-৮৬’। বুয়েটে রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে প্রায় ৯২ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করেছেন। শিক্ষার্থীদের হল আর বিভিন্ন হাসপাতালে বিনা মূল্যে এই স্যানিটাইজার সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে লোকবলসংকট দেখা দিয়েছে বলে জানালেন রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আইয়ুব আলী। দেশের বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান আর সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ চাইলে স্বেচ্ছাসেবায় লোকবল কিংবা কাঁচামালের জোগান দিয়ে সাহায্য করতে পারেন আমাদের। আমরা ভবিষ্যতে আরও হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করতে চাই। কারণ, বর্তমানে দেশের অনেক মানুষই কেনার সামর্থ্য রাখে না। আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ 

হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করছেন ড্যাফোডিলে শিক্ষার্থীরা
হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করছেন ড্যাফোডিলে শিক্ষার্থীরা

মাস্ক ও মূকাভিনয়
এদিকে বুটেক্সের টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের শিক্ষকেরা নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন মাস্ক বা কাপড়ের মুখোশ। শুরুতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভাগীয় প্রধান মাহ্​মুদুল হাসান। তাঁর ডাকে সাড়া দেন বিভাগের অন্য শিক্ষকেরাও। মাস্ক তৈরির জন্য যাবতীয় কাপড়ের জোগান দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেব্রিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। পরীক্ষামূলকভাবে ১৮ মার্চ ১০০টি মাস্ক তৈরি করেন তাঁরা। নমুনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। মাহ্​মুদুল হাসান বলেন, ‘এ কাজে আমাদের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে পারলে আরও ভালো হতো। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।’ করোনার ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক মাস্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। 

এ ছাড়া করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে সাধারণ মানুষের কী করণীয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়েছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের (ডুমা) শিল্পীরা মূকাভিনয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মূকাভিনয় নিয়ে হাজির হন তাঁরা। হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, করমর্দন বা কোলাকুলি না করার মতো বিষয়গুলো মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেন তাঁরা। মূকাভিনয়শিল্পী ও ডুমার প্রতিষ্ঠাতা মীর লোকমান বলেন, ‘আমাদের এই মূকাভিনয়ের মাধ্যমে অনেকেই সচেতন হয়েছেন।’ এখন যেহেতু ক্যাম্পাস বন্ধ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য মূকাভিনয়ের একটি ভিডিও তৈরি করেছেন তাঁরা।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে ব্যতিক্রমী এক দেয়ালপত্রিকা তৈরি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এই দেয়ালপত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে কোভিড-১৯–এর বিবরণ, এ রোগের লক্ষণ ও আক্রান্ত হলে করণীয় ইত্যাদি। রঙিন কাগজের ওপর লেখা আর হাতে আঁকা ছবির মাধ্যমে তথ্যগুলো স্থান পেয়েছে দেয়ালপত্রিকাটিতে।

টিএসসিতে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
টিএসসিতে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা