করোনাকালেও সুদিন দেখছেন ই-কমার্স উদ্যোক্তারা

ই–কমার্সে যুক্ত হয়েছেন অনেক নারী উদ্যোক্তা
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাজধানীর রাজাবাজারের আলমগীর হোসেন অনলাইনে টুকটাক কেনাকাটায় অভ্যস্ত ছিলেন। বাকিটা সশরীরে বাজারে বা বিপণিবিতানে গিয়েই সারতেন। দেশে গত মার্চ থেকে যখন করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শুরু হলো, তখন থেকে তাঁর কেনাকাটার ধরন পুরো উল্টে যায়। এখন বেশির ভাগ কেনাকাটা অনলাইনেই করেন।

শুধু আলমগীর হোসেন নন, অনেকেই করোনাকালে কেনাকাটায় অনলাইনকে বেছে নিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছেন। বাধ্যবাধকতা অভ্যাস তৈরি করেছে, আস্থা তৈরি করেছে। যার সুফল এখন দেশের ই-কমার্স খাত পাচ্ছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের ফরমাশ কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। কমে গিয়েছিল ইলেকট্রনিকস, মুঠোফোন, ফ্যাশনপণ্য, তথা পোশাক, জুতা, গয়না ইত্যাদির কেনাবেচা। এপ্রিল ও মে মাস এভাবে কাটার পর জুন থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। এখন নিত্যপণ্যের কেনাবেচা ভালো চলছে, আবার ইলেকট্রনিকস ও ফ্যাশনপণ্যের কেনাবেচাও মোটামুটি বেড়েছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা ভালো অবস্থানেই রয়েছে। তবে সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এক নয়।

উদ্যোক্তারা বেশি আশাবাদী মানুষের অভ্যস্ততা নিয়ে। তাঁরা বলছেন, করোনাকালে যে অভ্যাস ও আস্থা তৈরি হয়েছে, সেটা এ খাতকে এগিয়ে নেবে। ফলে, বাজারের আকার অনেকটাই বাড়বে।

ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষের ভরসা বেড়েছে। করোনার কারণে ক্রেতাদের বড় অংশ ঘরে বসেই নিত্যপণ্য কিনতে আগ্রহী। ফলে, সাধারণ সময়ের চেয়ে অনলাইনে কেনাকাটা অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, চাল, ডাল ও ওষুধের মতো পণ্যের বিক্রিই এখন বেশি। পবিত্র ঈদুল আজহায় অনলাইনে কোরবানির পশু ব্যাপক বিক্রি হয়েছে। কিন্তু করোনা আসার আগে অনলাইনে যেসব পণ্য বিক্রি হতো, সেগুলোর বিক্রি পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফেরেনি।

ই-ক্যাবের হিসাবে, দেশে ই-কমার্সের বাজারের আকার এখন ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা জার্মান ওয়েব পোর্টাল স্ট্যাটিস্টার জুলাই মাসের হিসাবে, চলতি বছর বাংলাদেশে ই-কমার্সের আকার দাঁড়াবে ১৯৫ কোটি ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। তাদের পূর্বাভাস হলো, ২০২০ সালে বৈশ্বিক ই-কমার্স ব্যবসার বাজারের আকার দাঁড়াবে দুই লাখ কোটি ডলার। সবচেয়ে বড় বাজার চীন। এরপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি।

বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের অনেকেই স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। খাত যে বড় হচ্ছে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। ওই বছর দুটি ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমত, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রিজি) চালু করে।

এরপর চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (ফোরজি) চালু হয়েছে। মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। অন্যদিকে ই-কমার্স খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ এসেছে। সব মিলিয়ে খাতটি বড় হয়েছে। ক্রেতা বেড়েছে। ই-ক্যাবের হিসাবে, তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০।

দেশে সুপরিচিত ই-কমার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দারাজ, চালডাল, প্রিয়শপ, আজকের ডিল, সদাগর, রকমারি, ফুডপান্ডা, সহজডটকম, সেবা এক্সওয়াইজেড, বইমেলা, বিক্রয়ডটকম, অথবা, সিন্দাবাদ, অর্থা, খাশ ফুড, মাই অর্গানিক বিডি ইত্যাদি। এর বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন খাতভিত্তিক ব্যবসা করে। সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে জোর দিচ্ছে।

করোনাকালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে নানাভাবে সেবা দিয়েছে। যেমন লকডাউনের আওতায় পড়ার পর রাজাবাজার ও ওয়ারীবাসীকে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। চাহিদা বিবেচনায় মোবাইল শপ চালু করা হয়। এ সময় চাল, ডাল, বিভিন্ন মুদিপণ্য, তাজা শাকসবজি, দুধসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল বিক্রি শুরু করে তারা। ১ ঘণ্টায় বা সর্বোচ্চ ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে বিনা মূল্যে ফ্রি হোম ডেলিভারি চালু হয়। ঘরে বসে পণ্য বুঝে পাওয়ার সুবিধা ও পণ্য হাতে পেয়ে দাম দেওয়ার সুবিধা থাকায় মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় আগ্রহী হন।

ই-কমার্স খাতে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ডেলিভারি সেবাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সময় পেপারফ্লাই, ই–কুরিয়ার, ই–ভ্যালি এক্সপ্রেস ডেলিভারিসহ বিভিন্ন ডেলিভারি সেবা শুরু হয়। পাঠাও, সহজ, ফুডপান্ডা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান মুদিপণ্য, ওষুধসহ নানান পণ্য, স্বপ্ন ও অন্যান্য আউটলেট থেকে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সেবা চালু করে। এর বাইরে বেশ কিছু নতুন উদ্যোক্তা পণ্যের ডেলিভারি পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করে। ই-কমার্সের উদ্যোক্তারা এ সময় চাহিদার চাপ সামলাতে নতুন কর্মীও নিয়োগ করেন।

অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গোয়ালার উদ্যোক্তা শফিউল আলম বলেন, তাঁরা অনলাইনে দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করে থাকেন। গত ছয় মাসে রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ থাকায় মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে দুগ্ধজাত খাবার অনলাইনে ফরমাশ দিয়েছেন। মানুষ এখন অনলাইন কেনাকাটাকে আগের চেয়ে নিরাপদ মনে করছেন। আর অনলাইনে খাঁটি পণ্য পেতে চাইছেন।

ই-কমার্সের বাজার বড় হওয়ার কথা বলেছেন প্রিয়শপ ডটকমের আশিকুল আলম খান। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও মুদিপণ্যের বিক্রি বেড়েছে। অনলাইনে পাঠদানের কারণে স্মার্টফোনের বিক্রিও বেড়েছে। মানুষ এখন দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহার করে এতে ঝুঁকছেন।

সদাগরের সিইও আরিফ চৌধুরী বলেন, যেসব ই-কমার্স উদ্যোক্তা এ সময় ভালো সেবা দিতে পেরেছেন, সবার প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসা বেড়েছে দ্বিগুণ।

সরকারের পক্ষ থেকেও ই-কমার্স খাতটিকে এগিয়ে নিতে নানা সহায়তা করা হয়েছে। ঈদের সময় সরকার ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোরবানির পশু বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল হাট চালু করা হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেওয়া সাধারণ ছুটিকালে ও এলাকাভিত্তিক লকডাউনে ই-কমার্স খাত বড় ভূমিকা রেখেছে। সারা দেশে ই-কমার্সকে ছড়িয়ে দিতে ফুড ফর নেশন, একশপের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে এ খাতে নতুন পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশাবাদী তিনি।

উদ্যোক্তারা এখন ই-কমার্সকে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেছেন, ঢাকায় বাজার বড়। তবে ঢাকার বাইরে অনলাইন বেচাকেনা কম। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে সরবরাহের খরচ বেড়েছে। ফলে অনলাইনে পণ্য বিক্রি সাময়িক বাড়লেও সারা দেশে এর প্রভাব পড়েনি। সরবরাহ সুবিধা বাড়ানো হলে ও খরচ কমলে অনলাইনে কেনাবেচা আরও বাড়বে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দ্রুতগতির ফোরজি নেটওয়ার্কের কারণে অধিকাংশ মানুষ অনলাইন বাজারে আসতে পারছেন। দ্রুতগতির ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে অনেকটাই সহজ করেছে। করোনাকালে এসে মানুষ এ প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি ধরতে পেরেছে। তাই দ্রুতগতির ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে বদলে দিচ্ছে।