কারিগরি শিক্ষায় পাওয়া আত্মবিশ্বাস

>১৫ জুলাই বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস। বিশেষ এই দিনটি সামনে রেখে আজ থাকল চার তরুণের গল্প, কারিগরি দক্ষতা যাঁদের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। লিখেছেন হাসান ওয়ালী
ইশরাত জাহান
ইশরাত জাহান

ইশরাতের লড়াই

২০১৫ সালে রান্না ও হোটেল ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণের খোঁজ পান ইশরাত জাহান। ঢাকার মিরপুর কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইশরাত বন্ধুদের কাছেও তাঁর ভাবনার কথা বলেন। কিন্তু রান্নার এই কোর্স নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি কেউ। শেষমেশ একাই প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশনাল প্রোগ্রামসে (ইউসেপ) প্রশিক্ষণ শুরু করেন ইশরাত। তিন মাস শেষে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয় ঢাকার র​্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে। পরে সেখানেই স্থায়ী কাজের সুযোগ মেলে ইশরাতের।

সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু কাজ শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ইশরাতের জীবনে দুঃসময় নেমে আসে। বাবা মারা যান ২০১৮ সালে। শুরু হয় নতুন লড়াই। ছোট ভাই ও মাকে নিয়ে ইশরাতের সংসার। তত দিনে র​্যাডিসন ব্লুতে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন প্রশিক্ষণ শিখে আসা নানা কিছু কাজে লাগিয়ে। এখন ইশরাতের মাসিক আয় তাঁর সমসাময়িক অনেক বন্ধুর চেয়ে বেশি।

ইশরাত বলছিলেন, ‘আমার পুরো পরিবার এখন আমি চালাচ্ছি। ভাবতেই ভালো লাগে যে আমি দায়িত্ব নিতে পারছি। আমার যে বন্ধুরা তখন প্রশিক্ষণটিকে পাত্তা দেয়নি, তারা এখন আফসোস করে। আমিও ভাবি, প্রশিক্ষণ না করলে কী যে হতো!’

এত কিছুর মধ্যেও নিজের পড়াশোনা বন্ধ করেননি ইশরাত। মিরপুর বাঙলা কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করছেন তিনি। নিজের অবস্থানে আরও বেশি ভালো করার তাড়না থেকেই লড়াই করছেন প্রতিনিয়ত।

সাইফুল ইসলাম
সাইফুল ইসলাম

সাইফুলের উপার্জনের আনন্দ

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাইফুল ইসলাম। ‘মিস্ত্রি সাইফুল’ নামে এলাকায় এক নামে পরিচিত। আশপাশের দুই-চার গ্রামের কারও বিদ্যুৎ কিংবা পানির সংযোগ লাইনে সমস্যা হলেই ডাক পড়ে সাইফুলের। ২৩ বছর বয়সী সাইফুল কখনো নিজে যান, কখনোবা দুই সহকারীকে পাঠান। এসবই চলে মোবাইল ফোনে। সাইফুলের নির্দিষ্ট কোনো দোকান কিংবা সারাইখানা নেই। তাতেই প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ৮০০ টাকা। হাতের কাজের সুনামই তাঁর পরিচিতি।

গাইবান্ধা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ২০১৫ সালে তড়িৎ বিষয়ক ছয় মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম। এরপরেই নেমে পড়েন কাজে। সেই থেকে শুরু। এর মধ্যেই স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন সাইফুল। পাশের শোভাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী তিনি। শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবেন এমন নয়, মা-বাবার দেখভাল কিংবা ঈদ-উৎসবে ভাগনে-ভাগনিদের আদর আপ্যায়ন—সবই হাসিমুখে করেন সাইফুল। নিজের উপার্জনে চলার যে একটা আনন্দ আছে, সেটা তিনি উপভোগ করছেন।

সাইফুল পড়াশোনা করছেন ঠিকই, কিন্তু আর দশজনের মতো জমি–জায়গা বিক্রি করে চাকরি নেওয়ার পক্ষে নন তিনি। বলছিলেন, ‘সবাই তো ওপর লেভেলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করে। আমি একটা পজিশন (অবস্থান) ধরি আছি। তা বাদে পড়াশোনা করতেছি। চাকরিবাকরি যদি হয় হলো, না হলে এ কাজেই আগায়ে যাব। এ লাইনটা ভালোই।’

সাইফুল মাঝে কিছুদিন এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে থেকে কিছু করার তাড়না থেকেই ফিরে আসেন। এলাকার দুই ছোট ভাইকে কাজ শিখিয়ে রেখেছেন নিজের কাছে। স্বপ্ন দেখছেন স্থায়ী দোকান আর বড় একটি কর্মীদলের।

ফারজানা আক্তার
ফারজানা আক্তার

ফারজানার কাঁধে বড় দায়িত্ব

২০১৪ সালের এক সকালে বাবার ছায়া সরে যায় ফারজানা আক্তারের মাথার ওপর থেকে। বাবার মৃত্যুর সংবাদে মুষড়ে পড়েন সদ্য এসএসসি পাস করা ফারজানা। বুঝতে পারেন, বড় হতে গেলে নিজে থেকেই কিছু করতে হবে। সে সময় খোঁজ পান, ইলেকট্রনিকস–সংক্রান্ত কাজ হাতে–কলমে শেখা যাবে আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশনাল প্রোগ্রামসে (ইউসেপ), একটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। সুযোগ হাতছাড়া করেননি ফারজানা। ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষ না হতেই চাকরি পান একটি সৌরশক্তি নিয়ে কাজ করা কোম্পানিতে।

ফারজানা এমন একটা সুযোগই খুঁজছিলেন। প্রতি মাসের আয় দিয়ে নিজের থাকা, পড়াশোনা চালিয়ে লক্ষ্মীপুরে বাড়িতে মায়ের কাছে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। এর মধ্যেই শেষ করেন উচ্চমাধ্যমিক। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ভর্তি হন মিরপুর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে; ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তিতে।

নিজ গুণেই ফারজানা ২০১৭ সালে যুক্ত হন একটি জার্মান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এমই সোলশেয়ার লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানে ফারজানা একটি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কাজ করছেন প্রডাকশন সুপারভাইজার হিসেবে।

এখনো অবসরে এসএসসির পরের ওই প্রশিক্ষণের কথা ভাবেন ফারজানা। ‘আমার অধিকাংশ বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেছে। আর অন্য যারা পড়াশোনা করেছে, তারা ভালো চাকরি পাচ্ছে না। সেখানে আমি নিজে আয় করে পড়ে, বাড়িতে সাহায্য করে ভালো আছি।’

ফারজানা স্বপ্ন দেখছেন আরও বড় দলে নেতৃত্ব দেওয়ার। তাই পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে চান শেষ অবধি। ২০১৪ সালের কিশোরী ফারজানার কথা মনে করেই সামনের দিকে তাকানোর সাহস পান তিনি।

সোহেল রানা
সোহেল রানা

হাতে-কলমে শিক্ষাই সোহেলে শক্তি

২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সোহেল রানা। সিদ্ধান্ত নেন, ডিপ্লোমা প্রকৌশলে পড়বেন। কিন্তু বাদ সাধে পরিবার। বন্ধুরা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হবে, পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে। আর সোহেল কিনা পড়বেন ডিপ্লোমা! মানতে চান না পরিচিতদের অধিকাংশই। কিন্তু সোহেল তো নাছোড়বান্দা। বগুড়া থেকে চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ড্যাফোডিল পলিটেকনিট ইনস্টিটিউটে; টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলে।

শুরু হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। ঢাকা শহরে নিজে থাকা এবং পড়াশোনার খরচ চালানোর চাপ আসে সোহেলের কাঁধেই, কিন্তু তাতে দমেননি তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করেন। ডেটা এন্ট্রি থেকে শুরু করে নানা কাজে নিজেকে জড়িয়েছেন সোহেল। তাতে টাকার পাশাপাশি ঝুলিতে জমা হয়েছে অভিজ্ঞতা।

সোহেল বর্তমানে কাজ করছেন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) ই-কমার্স ওয়েবসাইট ‘একশপ’-এর প্রযুক্তি সহকারী (টেকনোলজি অ্যাসিস্ট্যান্ট) হিসেবে। এর মধ্যেই ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দেশের অন্যান্য অনেক ই-কমার্স সাইটের দেখভাল করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। আর সোহেল সফটওয়্যারকেন্দ্রিক যাবতীয় সেবা দেন প্রতিষ্ঠানকে।

পেছন ফিরে এইচএসসির পরবর্তী সময়ের কথা মনে করেন সোহেল। ‘আমি ভেবেছিলাম, সাধারণ পড়াশোনা আমার জন্য যথেষ্ট নয়। ওই সময়ে দ্রুত উপার্জনের পথ পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারিগরি শিক্ষায় সেটা সম্ভব হয়েছে। আমি একই সঙ্গে চাকরি করতে পেরেছি, আবার কাজের অভিজ্ঞতাও পেয়েছি।’

পরবর্তীকালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়লেও আজকের অবস্থানে উঠে আসার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে কারিগরি শিক্ষা—এ কথা অকপটে স্বীকার করেন সোহেল। ‘কারিগরি শিক্ষা হাতে–কলমে শেখায়। এই অভিজ্ঞতা চাকরিতে সাহায্য করে। যেখানে কাজের শুরুতে আমাকে আরও অনেকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কথা ছিল, সেখানে বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকায় শুরুতেই ভালো পদে কাজ করতে পেরেছি,’ বলছিলেন তিনি।