কিন্তু কেন–৩

উত্তর লিখতে গিয়ে কি মাথা খাটাতে হচ্ছে?
ছবি: প্রথম আলো

আচ্ছা, তাহলে প্রথমে পুরোনো বকবকানি শেষ করে নেওয়া যাক।

‘কিন্তু কেন সিরিজের লেখাগুলোতে আমরা মূলত গণিতের সেই সব সিম্পল ট্রিক,ফর্মুলা বা গণিতের রহস্যের ঘটনার পেছনের ঘটনা বের করে আনব, যা আমরা স্কুল–কলেজে হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকি। যেমন কোনো সংখ্যার সবগুলো অঙ্কের যোগফল ৩ দ্বারা বিভাজ্য হলে, মূল সংখ্যাটিও ৩ দ্বারা বিভাজ্য। আবার, চাঁদা ছাড়াই কীভাবে পেনসিল-কম্পাসের সাহায্যে ৬০​°​ বা ৯০​°​ কোণ আঁকা যায়, সেটা কখনোই এদিক–সেদিক হয় না। কিন্তু কেন?’

আজকে তৃতীয় পর্বে আমরা যে রহস্য নিয়ে কথা বলব, তা হচ্ছে ‘দুটি সংখ্যার লসাগু আর গসাগু গুণ করলে সংখ্যা দুটির গুণফলের সমান হয়। কিন্তু কেন?’

এই রহস্য সমাধানের আগে চলো লসাগু (LCM) আর গসাগুর (GCD/GCF) সংজ্ঞা আগে জেনে নিই।

উইকিপিডিয়া সার্চ করে লসাগু–গসাগুর যে সংজ্ঞা পাওয়া গেল, তা দিয়ে লসাগু–গসাগু বোঝার চেয়ে মাথায় যা আছে তা গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমরা ওদিকে যাব না, সহজ করে জিনিসগুলো বোঝার চেষ্টা করব। চমক ভাইয়ের মতে, ‘feel’ করার চেষ্টা করব।

ধরো, তোমার কাছে দুটি সংখ্যা আছে। এদের লসাগু হচ্ছে তৃতীয় এমন একটি সংখ্যা সংখ্যা, যাকে আগের ওই দুটি সংখ্যা দ্বারাই নিঃশেষে ভাগ করা যায়, কিন্তু একটি শর্ত আছে। চিন্তা করে দেখো, কোন শর্ত না থাকলে পৃথিবীতে যেকোনো দুটি সংখ্যার লসাগু লাখ লাখ হতে পারে। যেমন ৩ আর ৫–এর লসাগু তখন হতে পারত ১৫, ৩০, ৪৫...। কিন্তু একটি শর্ত দ্বারা তার রেশ টেনে ধরা হয়েছে। শর্তটি হচ্ছে, তৃতীয় সংখ্যাটিকে সর্বনিম্ন হতে হবে। তাই ৩ আর ৫–এর লসাগু হলো ১৫, কখনোই ৩০ বা ৪৫ নয়। (সব শর্ত পূরণ করলে ওই দুটির মাঝে যেকোনো একটিও লসাগু হতে পারে।)

এবার আসা যাক গসাগুর কথায়।

এখানেও আগের মতো দুটি সংখ্যা ধরো। এদের গসাগু হচ্ছে তৃতীয় এমন একটি সংখ্যা, যা আগের ওই দুটি সংখ্যাকেই নিঃশেষে ভাগ করে, এখানেও আগের মতো একটি শর্ত আছে। শর্তটি হচ্ছে তৃতীয় সংখ্যাটিকে যত দূর সম্ভব সবচেয়ে বড় হতে হবে। (আগের মতোই বলি, সব শর্ত পূরণ করলে ওই দুটির মাঝে যেকোনো একটিও গসাগু হতে পারে।)

লসাগু বা গসাগু নির্ণয়ের সময় সংখ্যাগুলোকে কেবল ‘সংখ্যা’ হিসেবে নয়, বরং ‘মৌলিক গুণনীয়কের গুণফল’ হিসেবে চিন্তা করা হয়। এতে অনেক লাভ।

ছোটবেলায় আমি এভাবে চিন্তা করতাম, আচ্ছা, দুটি সংখ্যার লসাগু বের করতে এত প্যাঁচ কেন? সংখ্যা দুটি গুণ করে দিলেই তো হয়।

কিন্তু উৎপাদকে বিশ্লেষণ শেখার পর এই চিন্তা মাথা থেকে সরে যায়। কারণ, সংখ্যা দুটিকে গুণ করলে ‘সাধারণ গুণিতক’ ঠিকই পাওয়া যায়, তবে তা ‘লঘিষ্ট’ (ছোট) হয় না।

আর এর জন্যই মৌলিক উৎপাদকের ব্যবহার। ১৫ আর ২৫–এর লসাগু তাই ১৫×২৫=(৩×৫)×(৫×৫) নয়। দুই জায়গাতেই একটি ৫ কমন, তাই একটিকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া হয়। লসাগু হয় (৩×৫×৫)। আর এর ভেতরেই (৩×৫) আর (৫×৫) খুঁজে পাওয়া যায়।

আচ্ছা, এক মিনিট!

লসাগুতে যে উৎপাদকটিকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া হয়, আমরা যদি দেখাতে পারি সেটাই হচ্ছে সংখ্যা দুটির গসাগু, তাহলেই কিন্তু আমরা আমাদের রহস্যের সমাধান করে ফেলব। কারণ, দুটি সংখ্যার গুণফল আর তাদের মৌলিক গুণনীয়কের গুণফল তো আসলে একই কথা।

গসাগু মানেই হলো ‘যে মৌলিক উৎপাদকটি বা উৎপাদকগুলো সবার মাঝে আছে’। চিন্তা করে দেখো তো, আমরা দুটি সংখ্যার লসাগু বের করার সময় বেছে বেছে কোন উৎপাদককে ছেঁটে ফেলে দিয়েছি?

যা সবার মাঝে ছিল। মানে মূল কথা হলো, সেটাই হচ্ছে গসাগু ছিল।

এই সম্পূর্ণ বক্তব্যটিকে বীজগণিতের মাধ্যমে মাত্র কয়েক লাইনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়।

ধরা যাক, a ও b দুটি সংখ্যা।

এবং, a ও b–এর গসাগু = q

তাহলে, বলা যায়, a=mq এবং b=nq

সুতরাং, তাদের লসাগু (LCM)=mnq

সংখ্যা দুটির গুণফল=a×b=mq×nq = mnq2

লসাগু–গসাগুর গুণফল= mnq×q= mnq2

অর্থাৎ সংখ্যা দুটির গুণফল= লসাগু গসাগুর গুণফল

প্রথম থেকে এত বকবক না করে হয়তো শেষের এই কয়েকটি লাইন লিখলেই হতো, কিন্তু তখন চমক ভাইয়ের মতে, বিষয়টা ‘feel’ করা যেত না...

যাওয়ার আগে একটি প্রশ্ন, সম্পূর্ণ লেখাটি খেয়াল করে দেখবে, খুব সাবধানে এখানে সব সময় ‘দুটি’ সংখ্যার লসাগু বা গসাগু নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তিনটি বা তার অধিক সংখ্যার লসাগু–গসাগুর ক্ষেত্রেও কি ‘লসাগু–গসাগুর গুণফল সংখ্যাদ্বয়ের গুণফলের সমান’ এই কথাটা খাটবে।

চিন্তা চলতে থাকুক।

সত্যি হোক গণিতের স্বপ্নযাত্রা।