ক্যাম্পাসে দল বেঁধে গাই গান

>ক্যাম্পাসের ক্যানটিনে, সিঁড়িতে কিংবা ছোটখাটো অনুষ্ঠানগুলোতে গান করতে করতেই গড়ে ওঠে কিছু ব্যান্ড দল। মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় তাদের নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কোনো কোনো ব্যান্ডের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শিক্ষার্থীরা তখনো গর্ব করে বলেন ‘আমাদের’ ক্যাম্পাসের ব্যান্ড

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর গিটার হাতে টুংটাং করা ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় ছোটবেলায় গান শেখা মেয়েটার। একটা ছেলে হয়তো শখের বশেই বাঁশি শিখেছে। ওদিকে আরেকজন ছন্নছাড়া হয়ে একেক ব্যান্ড দলের সঙ্গে ড্রামস বাজিয়ে বেড়ায়। এই সব মানুষকে এক করে দেয় একটা ক্যাম্পাস।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যান্ড স্বরব্যাঞ্জো
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যান্ড স্বরব্যাঞ্জো

অনেক ব্যান্ড দলের গড়ে ওঠার গল্পটাই এমন। এরপর ব্যান্ড ভাঙে, গড়ে। দলের কেউ হয়তো গানবাজনা ছেড়ে পড়ালেখায় মন দেয়, কেউ চলে যায় বিদেশে, কেউবা এক দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়। তবু একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা একেকটা ব্যান্ডের গানে-সুরে-পছন্দে সেই ক্যাম্পাসের একটা রেশ থেকেই যায়। নিজেদের চেনা পরিসরে, চেনা মুখগুলোর সামনে একের পর এক অনুষ্ঠান করতে করতেই দলগুলোর মধ্যে ভালো বোঝাপড়া তৈরি হয়। সুযোগ হয় নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষ্ণপক্ষের পরিবেশনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষ্ণপক্ষের পরিবেশনা

দল হয়ে ওঠা
এই তো গত বছরের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, সুইমিংপুল, জগন্নাথ হলের গ্যালারিসহ ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় বসে দল বেঁধে গান করতেন অর্থনীতি বিভাগের তারেক, নাট্যকলা বিভাগের রুবেল, পরিসংখ্যান বিভাগের বাপন ও লাইব্রেরি সায়েন্স বিভাগের পার্থ। ব্যান্ড গড়ার ভাবনা তখনো মাথায় ছিল না। একটা এফএম রেডিওতে ডাক পেয়ে ভাবতে বসেন, দলটার একটা নাম তো দেওয়া লাগে। সেই থেকে তাঁদের নাম কৃষ্ণপক্ষ। গিটার, ইউকেলেলে, ব্যাঞ্জোর সুরে এরই মধ্যে নামটি ক্যাম্পাসে পরিচিতি পেয়েছে। দলে যোগ হয়েছেন আরও কয়েকজন।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যান্ড প্রজেক্ট নীলের গড়ে ওঠার গল্পটাও অনেকটা একই রকম। ব্যান্ডের গিটারিস্ট টুকটুক বলছিলেন, ‘২০১৫ সালে ক্যাম্পাসে পয়লা বৈশাখে প্রথম কয়েকজন মিলে মিনার ভাইয়ের “আহা রে” গানটা করেছিলাম। এরপর “প্রজেক্ট নীল” নামে একসঙ্গে গান করতে শুরু করি। এখন আমাদের নিজেদের কিছু মৌলিক গান আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রেডিওতে শো করতে গেলেও আমরা নিজেদের নর্থ সাউথের ব্যান্ড বলেই পরিচয় দিই।’ দেখতে দেখতে দুই বছর পেরিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিতই মঞ্চে ওঠে প্রজেক্ট নীল। একটা গান শেষ হতে না-হতেই ‘ওয়ান মোর ওয়ান মোর’ স্লোগানে ব্যান্ডটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

নর্থ সাউথের মঞ্চে প্রজেক্ট নীল
নর্থ সাউথের মঞ্চে প্রজেক্ট নীল

চেনা মঞ্চ, চেনা মুখ
ক্যাম্পাসনির্ভর ব্যান্ডগুলো যে কিছুটা আলাদা সুবিধা পায়, সে কথা বললেন জলের গানের ভোকাল রাহুল আনন্দ। জলের গানকে তো সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ব্যান্ড হিসেবেই চেনে। চারুকলার সাবেক ছাত্র হিসেবে ক্যাম্পাসের সঙ্গে ব্যান্ডের আবেগের সম্পর্কটা রাহুল ভালোই বোঝেন। তিনি বলছিলেন, ‘ধরুন, আপনি গান শেখেন। বাসায় অতিথি এলে যেমন আবদার মেটানোর জন্য গান শোনাতে হয়, ক্যাম্পাসের ব্যান্ডগুলোও তেমন।’ চেনা প্রাঙ্গণে বেড়ে ওঠা ব্যান্ডের সুবিধার জায়গাটা রাহুল ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘গান ভালো হোক, খারাপ হোক, পরিচিত বলে এখানে সবাই প্রশংসা করে। এতে সুবিধা হলো আত্মবিশ্বাস বাড়ে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ক্যাম্পাসে গান করতে করতেই যেমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে বুয়েটের ব্যান্ড ‘মোহ’। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অনুষ্ঠানে দেখা মেলে তাদের। একটা গান শেষে নামার সুযোগ হয় না, তার আগেই দর্শকসারি থেকে ভেসে আসে জুনিয়রদের চিৎকার—আরও গান শোনানোর আবদার। এই বন্ধু-শ্রোতারাই তো মোহকে আরও ভালো কিছু করার মোহে ফেলে দেয়!

.
.

গান যখন হাতিয়ার
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এ সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড মেঘদলের। দলটির ভোকাল শিবু কুমার শীল বলছিলেন, বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে গানকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়েই মেঘদলের মেঘ জমেছিল। শামসুন্নাহার হলে পুলিশি আক্রমণ, লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ—নানা ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গতি পেয়েছিলেন তাঁরা।
এখানেই মেঘদলের সঙ্গে মিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যান্ড স্বরব্যাঞ্জোর। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লাখনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রতিবাদে তাঁরা গেয়েছেন ‘লাল আগস্টের গান’। সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে জন্ম নিয়েছে ‘ম্যানগ্রোভের কান্না’ গানটি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে স্বরব্যাঞ্জোর। ব্যান্ডটির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়ামিন ইস্ক্রা রহমান বলছিলেন, ‘গানকে আমরা বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করি।’

স্মৃতি জড়িয়ে গান
ক্যাম্পাসের সীমানা পেরিয়ে সারা দেশের তরুণদের প্রিয় ব্যান্ড হয়ে উঠেছে শিরোনামহীন। তবু এখনো বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বেশ অধিকার নিয়ে বলেন, ‘শিরোনামহীন তো আমাদের ক্যাম্পাসের ব্যান্ড।’ কারণটা ব্যাখ্যা করলেন শিরোনামহীনের ভোকাল তুহিন, ‘শুরুতে আমাদের দলের পাঁচজনের মধ্যে চারজনই ছিল বুয়েটের।’
শিরোনামহীনের দেখানো পথেই এখন পরিশ্রম করে যাচ্ছে বুয়েটের কিছু গানের দল। অনুজদের উদ্দেশে কিছু পরামর্শও দিলেন তুহিন। বললেন, ‘প্রচুর গান শোনো। চর্চা করো। নিজেদের শিল্পীসত্তা নির্মাণ করো। খুব দ্রুতই যেন খ্যাতি পেয়ে না বসে।’
ক্যাম্পাসের ব্যান্ডের গানগুলোর সঙ্গে যে অনেক আবেগ জড়িয়ে থাকে, তার প্রমাণ শিরোনামহীনের গান ‘ক্যাফেটেরিয়া’। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে প্রায় নিয়মিতই মঞ্চে দেখা যায় জনপ্রিয় এই ব্যান্ড দলটিকে। তুহিনদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দর্শকও চিৎকার করে গায়, ‘পড়ন্ত বিকেল ক্যাফেটেরিয়া উঁকি দিয়ে দেখি...।’ গান শুনতে শুনতে বিদায়ী শিক্ষার্থীরা চোখ মোছেন। যেন গানটা কেবল বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়া নিয়েই লেখা...