দায়িত্বে কেউ নেই, সংকটে

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

দুর্গাপূজার ছুটি শেষে ৯ অক্টোবর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ তিনটি পদ শূন্য থাকায় শিক্ষা, প্রশাসনিকসহ সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ১৮ ও ১৯ অক্টোবরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কবে নাগাদ এই পরীক্ষা হবে, তা বলার কেউ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সোমবার কয়েকজন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী হতাশা প্রকাশ করেন। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এখন মাঝিবিহীন নৌকার মতো। উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রার—তিনটি পদ শূন্য। শীর্ষপদগুলো শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ করা না হলে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন–ভাতাও বন্ধ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করছেন খুব শিগগির উপাচার্য নিয়োগ হয়ে যাবে। অবশ্য মন্ত্রণালয়ের আরেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, যদি শিগগির উপাচার্য নিয়োগ না হয় তাহলে সেখানকার কোনো জ্যেষ্ঠ কোনো শিক্ষককে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

গত ২৬ মার্চ তৎকালীন উপাচার্য ইমামুল হকের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে উপাচার্যকে দেড় মাসের ছুটি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২৭ মে তাঁর চার বছরের মেয়াদও শেষ হয়। এরপর এক মাস উপাচার্যশূন্য থাকা অবস্থায় গত ২৫ জুন উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পান কোষাধ্যক্ষ এ কে এম মাহবুব হাসান। তিনিও ৭ অক্টোবর মেয়াদ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছেন। এর আগে ১০ এপ্রিল নৈতিক স্খলনের অভিযোগে রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ফলে প্রধান তিনটি পদই শূন্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কমিটির সদস্য এবং বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. ইউনুস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন অভিভাবকহীন। ছয় মাস ধরে সিন্ডিকেট সভা নেই। ট্রেজারারের মেয়াদও শেষ। দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ প্রয়োজন।

এ কে এম মাহবুব হাসানকে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দেওয়ার পর তাঁর বেশ কিছু কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অনুগত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে নিজের বলয় তৈরি করে বিরুদ্ধমতের শিক্ষক–কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হেনস্তা করানোরও অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, গত সাড়ে চার মাসে সিন্ডিকেট সভা হয়নি। সর্বশেষ সভা হয় গত ২৭ মে। কিন্তু রুটিন দায়িত্ব পাওয়ার পর কোষাধ্যক্ষ মাহবুব হাসান অন্তত ১২ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ও নিজস্ব তহবিল থেকে ক্রয় ও বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন শিক্ষক বলেন, ভর্তি পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখ ছিল ১৮ ও ১৯ অক্টোবর। আর রুটিন উপাচার্য মাহবুব হাসানের কোষাধ্যক্ষের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৭ অক্টোবর। সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষা হবে কি না, এ নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় থাকলেও তিনি আগাম প্রশ্নপত্র ছাপানো বাবদ অর্থ ব্যয় করেছেন, যা অযৌক্তিক। তা ছাড়া ওই প্রশ্নপত্র তিনি বরিশালের একটি প্রেস থেকে ছাপিয়েছেন। এখন পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় সেই প্রশ্নপত্র কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চাহিদা অনুযায়ী তিন মাস অন্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য বরাদ্দ দেয়। বছরে একাডেমিক ও অন্যান্য খাত থেকে সাত থেকে আট কোটি টাকা আয় হয়। এ ছাড়া সাবেক উপাচার্যের সময়ে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ কিস্তির অর্থ তিনি পুরোপুরি ব্যয় করে যেতে পারেননি। মাহবুব হাসান রুটিন দায়িত্ব পাওয়ার পর বরাদ্দ পাওয়া এসব অর্থ তুলে ব্যয় করেছেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে সদ্যবিদায়ী কোষাধ্যক্ষ মাহবুব হাসান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত সম্ভবত আট কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। এর মধ্যে চার মাসে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাই দিয়েছি ছয় কোটি টাকা।’ কম্পিউটার কেনা এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য বিল পরিশোধের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘অনেক আগেই দরপত্রের মাধ্যমে কম্পিউটার কেনা হয়। আমি শুধু বিল পরিশোধ করেছি। এ ছাড়া অন্যান্য বিলও পরিশোধ করেছি। এটা আমার এখতিয়ার আছে বলেই করেছি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে মাহবুব হাসান বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষার তারিখ যেহেতু নির্ধারিত হয়েছিল, তাই আমি প্রস্তুতি হিসেবে প্রশ্নপত্র ছাপিয়েছি।’

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য না থাকায় একাডেমিক, অর্থ ও সিন্ডিকেট সভা হচ্ছে না ছয় মাস ধরে। এ কারণে সিলেবাস ও ফলাফল কার্যক্রম অনুমোদন দেওয়া যাচ্ছে না। খণ্ডকালীন শিক্ষকও নিয়োগ হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া জরুরি।