সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে মা–বাবার ভাবনা

ফাইল ছবি

পরিবার হলো একটি শিশুর নৈতিক শিক্ষালাভের প্রথম ভিত্তি। মা–বাবা ছোট থেকেই পারিবারিক শিক্ষায় সন্তানকে ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন। জীবনের শুরুতেই যদি তাঁরা সন্তানকে বাস্তবমুখী শিক্ষা দেন, তাহলে সেই সন্তান স্কুলে গিয়ে সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করবে, শিক্ষকদের সম্মান করবে। আর যদি মা–বাবা সন্তানকে সময় না দেন, যদি সে গৃহপরিচারিকার সাহচর্যে বেড়ে ওঠে, তাহলে সেই শিশু তার (গৃহপরিচারিকা) অনুকরণ করবে।

একসময় আমাদের দেশে পারিবারিক কাঠামো ছিল একান্নবর্তী। একসময় বাবা-মা, দাদা-দাদি, কাকা-কাকি, ফুফু সবাই এক পরিবারে বাস করতেন। তখন পরিবারের শিশুরা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করত। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতায় বাস্তবতার নিরিখে পরিবারগুলো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ছেলেমেয়েরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছে পারিবারিক সুসম্পর্ক থেকে, তেমনি বঞ্চিত হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা থেকেও আর ভুগছে একাকিত্বে। কখনো বেছে নিচ্ছে ভয়ংকর মৃত্যুকে।

মানুষ প্রকৃতি থেকে অনেক শিক্ষা পায়। একটি ছোট চারাগাছকে আলো, বাতাস, পানি দিয়ে পরিচর্যা করা হলে তবেই একটি ভালো ফলদ বৃক্ষে পরিণত হয়। তেমনি ছেলেমেয়ের শৈশব ও কৈশোরের সময়টুকু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মা–বাবার উচিত সন্তানের প্রতি যত্ন নেওয়া। তার খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ, কিসে তাদের ভালো লাগা–মন্দ লাগা সব খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি শিশুর সব রকম চাহিদা বাড়তে থাকে। কাজেই মা–বাবা কেবল টাকা দিয়েই সেই চাহিদা পূরণে খুশি থাকলে হবে না। ছেলেমেয়েদের সব চাহিদাও অনেক সময় সঠিক নয়, তাই সেদিকটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কোনটি তার বয়স উপযোগী। তাদের হাতে টাকা না দিয়ে প্রয়োজন বুঝে মা–বাবা সেই জিনিস কিনে দিতে পারলে ভালো। আর সন্তানকে মা-বাবার সামর্থ্যও বোঝাতে হবে। সাধ্যের বাইরে গিয়ে কোনো কিছুই ঠিক নয়। অন্যের ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুলনা না করে সন্তানকে নিজের সঙ্গেই তুলনা করতে শেখাতে হবে।

স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে সন্তানদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে মা–বাবাকে। মডেল: ওয়ারিশা, হাবিবা ও ইবশার
ছবি: সুমন ইউসুফ

অধিকাংশ মা-বাবা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাছে সন্তানকে রেখে যান। এতে ভালো দিকের চেয়ে খারাপ দিকেরই প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। প্রায়ই বিভিন্ন ঘটনা শুনতে ও দেখতে পাই। দেখা গেছে, গৃহপরিচারিকা মা-বাবার অনুপস্থিতিতে তাঁদের সন্তানকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, এমনকি শারীরিক নির্যাতনও করছেন। কিন্তু সারাদিন পর মা-বাবা বাড়িতে এলে ভয়ে সেকথা কারও কাছে বলতে পারছে না। এ কারণে দিনের পর দিন ভয় থেকে শিশুটির মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়। তখন সে স্কুলে গিয়েও বন্ধুদের সঙ্গেও মিশতে পারে না। টিফিনের সময় সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে না গিয়ে ক্লাসরুমে একা বসে থাকে। বাসায় কারও সঙ্গে তেমন কথা বলে না। এই শিশু জীবনের শুরু থেকেই আনন্দের ছোঁয়া পায়নি। দেখা যায়, এরাই একসময় ভয়ংকর হয়ে ওঠে। মা-বাবার সঙ্গেও একটা সময় খারাপ আচরণ করতে শুরু করে। তাই, মা-বাবাকে এই বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।

অপর দিকে, সন্তানকে কখনো নেতিবাচক কথা বলা ঠিক নয়। যেমন তোর দ্বারা কিছু হবে না, তুই পারবি না, তোর মাথায় কিছু নেই ইত্যাদি। এমনকি অন্যের সন্তানের সঙ্গে তুলনা করাও উচিত নয়, যেখানে আপনার সন্তানকে হেয় করা হয়। তাহলে সেই সন্তান বিদ্রোহ করতে পারে, এমনকি হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। তাই শিশুদের ভালো কথা বলে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। তাদের দিয়ে দাদা-দাদি, নানা-নানিকে ওষুধ খাওয়ানো কিংবা খাবার এনে দেওয়া, আর্তপীড়িতদের দান করা প্রভৃতি কাজগুলো শেখাতে হবে। বিশেষ করে বাড়িতে যাদের ছেলে সন্তান রয়েছে, তাদের শেখাতে হবে, কোনো মেয়ের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে মনে করতে হবে নিজের বোন। আর বোনের যেকোনো বিপদ–আপদে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। আধুনিক সভ্যতায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে ভয়ানক করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করতে হচ্ছে। তাই বলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় যদি মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে, তাহলে তা রোধ করতে হবে তাদের হাতে ভালো ভালো বই দিয়ে। জীবনে বিভিন্নভাবে বিখ্যাত হয়েছেন যেসব মহা-মনীষীরা, তাঁদের জীবনীমূলক বই ছোটবেলাতেই ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিতে হবে। পাঠ্যবইতে যা আছে, তাতে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে মহা–মনীষীদের জীবনী, বিজ্ঞানচেতনা, ভ্রমণ কাহিনি, উপন্যাস—এ ধরনের বই পড়া উচিত। সমাজে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সম্পর্কে ধারণা দেওয়া ও কর্মস্থল পরিদর্শন করানো, তাহলে ছেলেমেয়েরা ভাবতে শিখবে। বিভিন্ন পেশায় মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগবে। সন্তানকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা মোটেও ঠিক নয়। কারণ তারা কোনো মেশিন বা যন্ত্র নয় যে প্রেসার দিলেই যন্ত্র চলবে। তাদেরকেও স্বাধীনতা দিতে হবে। আসলে কোনো মানুষই পরাধীন থাকতে চায় না। পড়ার ক্ষেত্রেই বলা যায়, আজকাল বেশির ভাগ মা-বাবাই চান, যত বেশি চাপে রাখা যাবে তত পড়া আদায় করা যাবে। স্কুলের পর তাদের বিশ্রামের কথাটাও না ভেবে প্রাইভেটে পড়তে যেতে হবে। দিনরাত শুধু প্রাইভেট, তাহলে নিজেরা পড়বে কখন? যেমন খাওয়াদাওয়া নিজের ওপর ছেড়ে দিলে ছেলেমেয়েরা নিজের হাতে ইচ্ছেমতো মেখে তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারে। কিন্তু মা-বাবা যদি তাঁদের পছন্দের খাবার সন্তানকে জোর করে খাওয়াতে চান, তবে তা হয় গেলানো। তেমনি শিক্ষক যদি সবই বলে দেন, নোট তৈরি করে দেন, তাহলে ওরা নিজেরা ব্রেন খাটাবে কখন? বরং মা-বাবা যদি প্রাইভেট কমিয়ে নিজেকে পড়ার সুযোগ করে দেন, তাহলে ধীরে হলেও উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। তারপর দেখা যায়, ছেলে বাংলা পড়ছে, তখন মা বলল, এখন অঙ্ক করো। এরপর বায়োলজিটা শেষ করো। এভাবে কখনো পড়া হয় না। তাকে স্বাধীনভাবে পড়তে দেওয়া উচিত। কোনো বিষয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। প্রায় সময়ই দেখা যায়, নবম শ্রেণিতে বিষয় নির্বাচনেও মা-বাবা ঠিক করে দেন সন্তান কোন বিভাগে পড়বে। মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় সায়েন্স পড়লে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়, আর্টস কিংবা কমার্স পড়লে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না—এ ধরনের কথা সন্তানের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। শিশু বয়সে চাপিয়ে দেওয়া বিষয় অনেক সময়ই ছেলেমেয়েদের জন্য সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ছেলে বা মেয়েটি আর্টস নিয়ে পড়লে তার বেশি ভালো হতো। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের মেধার মূল্যায়ন না করে মা-বাবার ইচ্ছা যখন ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় সন্তানকে, দেখা যায় তারা কাউকে বলতে পারছে না যে সে সায়েন্স পারছে না। তার উচ্চতর গণিত কিংবা পদার্থবিজ্ঞান ভালো লাগছে না বলেই ভালো নম্বর পাচ্ছে না। দিনের পর দিন রেজাল্ট খারাপ করার জন্য স্কুল থেকেও শিক্ষকেরা ভালো দেখছেন না, বন্ধুদের কাছেও লজ্জিত হচ্ছে। মা-বাবার কাছে বকুনি খাচ্ছে। এত প্রাইভেট দিলাম তবুও ভালো নম্বর পাওনি, কেন? কিন্তু একবারও ভেবে দেখছে না প্রতিযোগিতার পড়াশোনাটায় প্রতিনিয়ত সে হেরে যাচ্ছে। আর হতাশা বাড়ছে। ধীরে ধীরে তার আত্মার মৃত্যু ঘটছে। অথচ মা-বাবা যে ধীরে ধীরে সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, তা একবারও ভাবছেন না। এটি কখনো কাম্য নয়। ছেলেটি কত হাস্যোজ্জ্বল ছিল, খেলাধুলো করত, ভালো বাঁশি বাজাতে পারত, কিন্তু মা-বাবার চাপিয়ে দেওয়া পড়াশোনার কারণে দেখা যায় এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি, তাই ভালো কলেজে পড়তে পারেনি। এ কারণে তার ইচ্ছাগুলোও চাপা পড়ে যায়। হতাশায় জীবন হয়ে যায় এলোমেলো। ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে না। কোনো প্রতিযোগিতায় নিজেকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারে না। অথচ হতে পারতো সে একজন বড় সাহিত্যিক, শিল্পী কিংবা পাইলট।

তাই সবশেষে বলতে চাই, ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা দিলে তাদের দায়িত্বজ্ঞানও বাড়ে। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে লেগে থাকলে ওরা মনে করে পড়াশোনা করানোটা মা-বাবার দায়িত্ব। কিন্তু যদি ওদের ইচ্ছেমতো বিষয় নির্বাচন করতে দেওয়া হয় বা যে বিষয়ে তার বেশি আগ্রহ আছে কিংবা ভালো লাগে, ভালো নম্বর পায়, সে বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করে জীবনে সফল হবেই। এতে ছেলেমেয়েরা নিজের প্রতি দায়িত্বশীল ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কোথায় কোন ধরনের কোর্স চালু আছে কিংবা কোথায় কোন বই পাওয়া যায়, কোন বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হবে, কোন বিষয়ে হবে না সব নিজেই বুঝে নিতে পারবে। এতে মা-বাবার দুশ্চিন্তাও অনেকটা কমে যায়।
মোট কথা, মনে আনন্দ না থাকলে পড়া হয় না। তাই ওদের নিজেদের স্বাধীনভাবে পড়ার সুযোগ দিলে পরিবার ও সমাজের যেমন মঙ্গল হবে, তেমনি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

*লেখক: স্বপ্না সরকার, সিনিয়র শিক্ষক, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।