অনেক বড় একটি জায়গা শূন্য হলো

১৯৭২ সাল। আমি তখন তিতাস একটি নদীর নাম ছবিটি প্রযোজনা করব বলে ঠিক করি। এটি ছিল আমার প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজনা। আমার ইচ্ছা যে পরিচালক হবেন ঋত্বিক দা। তবে শিল্পী ও কুশলীরা হবেন এ দেশের। ঋত্বিক দার সঙ্গে সব কিছুই চূড়ান্ত হলো। শিল্পী নির্বাচন করা হলো। তখন বেবী ইসলামের কথা শুনেছি। তাঁর বেশ নামডাক। আমি গেলাম তাঁর কাছে। ঋত্বিক ঘটক অনেক বড় নির্মাতা। বেবী ভাই সানন্দেই রাজি হলেন। সমস্যা হলো, ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে বেবী ভাইয়ের কোনো পরিচয় বা জানা-শোনা ছিল না। ফলে ঋত্বিক দা সবকিছু বেবী ভাইয়ের ওপর ছাড়তে পারলেন না। কিন্তু কয়েক দিন কাজ করার পরেই দেখলাম, চিত্রগ্রহণের ব্যাপারে ঋত্বিক ঘটক পুরোপুরি বেবী ভাইয়ের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করলেন। সেই যে সুসম্পর্ক হলো, তাও ছিল দেখার মতো।ঋত্বিক ঘটক বেবী ভাইকে বললেন, একটি আবেগপ্রবণ দৃশের চিত্রায়ণ হবে। শিল্পী রোজী আফসারী, কবরীসহ আরও অনেকেই। দৃশ্যটির কাজ যখন শেষ হলো, পরিচালক বললেন—কাট। ক্যামেরা থেমে গেছে। সবাই খুশি। বেবী ভাই ক্যামেরা থেকে চোখ সরালেন ঠিকই, কিন্তু চোখের পানি আড়াল করতে পারলেন না। সহকারী ক্যামেরাম্যান এসে বললেন, ক্যামেরায় যে জায়গাটি দিয়ে দেখা হয়, সেই জায়গাটি চোখের পানিতে ভিজে আছে!এই হলেন বেবী ভাই। কাজ করার সময় তিনি নিজেও শিল্পীদের এক একটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতেন। কাজ করার সময় বাইরের কোনো কিছুই তাঁকে যেন ছুঁতে পারত না। তাঁর মনের মধ্যে তখন শুধু ছবির চরিত্রগুলোই খেলা করত। ঋত্বিক ঘটক মুগ্ধ হয়ে গেলেন। পরে দেখা গেল, ভারতে যখন ঋত্বিক ঘটক যুক্তি তক্কো গপ্পো বানালেন, তখন বেবী ইসলাম হলেন সেটির চিত্রগ্রাহক।তিতাস একটি নদীর নাম ছবির পর আরও একটি ছবি প্রযোজনা করলাম, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। ছবির নাম চরিত্রহীন। এটি বেবী ভাই পরিচালনা করলেন এবং এর চিত্রগ্রহণও করলেন। একদিন কথায় কথায় একটি গল্প বললেন। তিনি তখন হারানো সুর ছবির অপারেটিভ ক্যামেরাম্যান। তাঁর গুরু অজয় কর ছবিটি পরিচালনা করছেন। প্রযোজক উত্তম কুমার। ছবির শিল্পী উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন।একটি বড় দৃশ্যের কাজ ছিল। পরিচালক শিল্পীদের কয়েকবার মহড়া দেওয়ালেন। এর পর চূড়ান্তভাবে দৃশ্যটি ধারণ করার জন্য চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামকে বললেন পরিচালক। দৃশ্যটির শুটিং শেষ হলো। পরে বেবী ইসলাম দেখেন, সবই ঠিক আছে, কিন্তু ক্যামেরার ভেতরে ফিল্ম ছিল না। এখন বিষয়টি তিনি আর অজয় করকে বলার সাহস দেখাতে পারছেন না। নিরুপায় হয়ে উত্তম কুমারকে গিয়ে বললেন, উত্তম বাবু, একটা ভুল হয়ে গেছে। ক্যামেরায় তো ফিল্ম ভরা ছিল না। এখন অজয় দাকে বলতে পারছি না। আপনি কী একটু ব্যাপারটা সামলে দেবেন? উত্তম কুমার পরিচালককে বললেন, দাদা এই দৃশ্যটির শুটিং আরেকবার দিই। পরিচালক বলেন, না না, তার দরকার নেই। ওটা ঠিকই আছে। উত্তম কুমার বললেন, আমার খুব ইচ্ছা করছে এবং অনুরোধ করছি যে দৃশ্যটির শুটিং আরেকবার করি। পরিচালক এবারে আর না করলেন না। ফিল্ম ভরে আবার শুটিং হলো। পরিচালক অজয় কর ঘটনা জানলেন অনেক পরে।অনেক দিন বেবী ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। শেষ দিকে এসে এফডিসি এবং চলচ্চিত্রের পুরো ব্যবস্থা নিয়ে তিনি নাখোশ ছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছিল তিনি অভিমান করেছেন। কিন্তু কেন ছিল এই অভিমান এবং কাদের ওপর, তা কখনোই বলতেন না। অভিমান নিয়েই তিনি চলে গেলেন। একজন বেবী ইসলামকে হারানো মানে, অনেক বড় একটি জায়গা শূন্য হলো। এই শূন্যতা পূরণ হবে কী করে বেবী ভাই? হাবীবুর রহমান খান: চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক