
অমিতাভ রেজা ও মেজবাউর রহমান সুমনের তত্ত্বাবধানে সাতজন তরুণ নির্মাতা তৈরি করেছেন সাতটি নাটক, এক মোড়কে যার নাম অস্থির সময় স্বস্তির গল্প। ডঙ্কা শুনে (পড়ুন ‘ট্রেলার দেখে’) মনে শঙ্কা জেগেছিল। আজকাল নাটক-সিনেমার সুন্দর ট্রেলার বড় প্রতারক হয়। ট্রেলার দেখে ‘ঘ্রাণে অর্ধভোজন’ সেরে দর্শক পুরো ভোজনের আশায় বসে থাকেন, কিন্তু পরিবেশনের পর কেবল বিষমই খেতে হয়। সে বিবেচনায় অমিতাভ-সুমনের সৈনিকেরা হতাশ করেননি। অস্থির সময় স্বস্তির গল্পতে ঘ্রাণ ও প্রাণ দুটোই ছিল।
সাত নির্মাতার নামের মধ্যে বড় চমক—নুহাশ হুমায়ূন। তাঁর নির্মিত হোটেল আলবাট্রোসও চমক-জাগানিয়া বটে। গল্প, ক্যামেরার কাজ আর সংলাপে নির্মাতা তাঁর নামের শেষ অংশের মান রেখেছেন। আলিশান হোটেলের একদল শেফকে নিয়ে এগোনো গল্পের পটভূমি সহজ ছিল না। আঁটসাঁট জায়গায় বেশ কায়দা করে ক্যামেরা ধরতে হয়েছে। আলো-আঁধারির খেল আর দৃশ্যের ভেতর কিছু অর্থবহুল ইনসার্ট মিলিয়ে পরিচালক নুহাশ বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ‘খুন করতে সাহস লাগে না, না করতে লাগে। ইউ ডিসাইড, তুমি কি মানুষ, নাকি মাংসের দলা!’ আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে সংলাপগুলো ভাবায়।
কবি আহসান হাবীবের ‘দোতলায় ল্যান্ডিং’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত নাটকটির নাম কথা হবে তো? পরিচিত গল্প, পরিচ্ছন্ন সংলাপ আর পরিমিত অভিনয়—সব মিলিয়ে কথা হবে তো? নিয়ে কথা তো হবেই। সৈয়দ আহমেদ শাওকী গল্পের খোঁজে খুব বেশি দূরে নয়, পাশের বাসায় গেছেন। পাশাপাশি ফ্ল্যাটের দুজনের এক-আধটু আলাপ, চোখাচোখি, মুখোমুখি...নাটকের রেসিপি পুরোনো হলেও স্বাদটা নতুন। কফির মগ হাতে বইয়ের পাতা ওলটানোর মতো আনন্দ নিয়ে এক বসায় নাটকটা দেখে ফেলা যায়।
সুকর্ণ সাহেদ ধীমানের মাহুত দেখে আবার শুধু বসে থাকলে চলে না, নড়েচড়ে বসতে হয়। আমরা যে একটি ছেলে-একটি মেয়ে-একটি প্রেম ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, ভাবতেই ভালো লাগে। গত ঈদে রেদওয়ান রনি বলেছিলেন, ‘জনি’ নামের এক কুকুরের গল্প, এবার ধীমান নিয়ে এলেন গোলাপ বাহাদুর নামের এক হাতিকে। গল্পে গোলাপ বাহাদুর (চরিত্রের নাম রাঙ্গু) স্রেফ অলংকার হয়ে থাকেনি, নাটকের পাত্রপাত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রীতিমতো ‘অভিনয়’ করেছে। জেলখানার দৃশ্য কিংবা একজন মাহুতের জীবন দেখাতে গিয়ে ধীমান কোনো ফাঁকিবাজির আশ্রয় নেননি।
ফাঁকি না থাকলেও খানিকটা ফাঁক থেকে গেল জাহিন ফারুক আমিনের শ্যাওলায়। কিছু সংলাপ অনবদ্য বলেই কিছু সংলাপে খটকা লাগে। কিছু দৃশ্য চোখে লেগেছে, আবার কিছু দৃশ্য চোখে লেগে আছে। যেমন একদম শেষ দৃশ্যটার কথা বলতেই হয়। নাটকের গল্পে ঘটনাক্রমে একটা পুলিশি জটিলতায় ফেঁসে যায় দুই তরুণ-তরুণী। রাতভর নানা হ্যাপা শেষে তারা যখন বেরিয়ে আসে, তখন দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ‘এটাই বোধ হয় ২৮২ নম্বর বাসা।’ নাটকের শেষ সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় সোডিয়াম বাতিগুলো। আহা!
‘আহা!’ বলে ওঠার আরেকটা সুযোগ করে দিয়েছেন তারিক আনাম খান। প্রতিশোধ নাটকে পুরো ৪০ মিনিট তিনি একাই তো মনোযোগ ধরে রাখলেন! আবিদ মল্লিকের পরিচালনায় নাটকের নামই গল্পটা বলে দেয়, শুরুর খানিকটা অংশ দেখলে শেষটা সহজেই অনুমান করা যায়। তবু তারিক আনাম খানের অভিনয় আর দৃষ্টিনন্দন লোকেশন শেষ পর্যন্ত দর্শককে আটকে রাখার কথা। লোকেশনটা শতভাগ কাজে লাগানোর জন্য পরিচালকের পাশাপাশি চিত্রগ্রাহক দলের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
ধন্যবাদ পাবেন নির্মাতা তানভীর আহসানও। আজকাল অধিকাংশ নাটকই দেখতে ফেসবুকের হোমপেজের মতো লাগে। মনে হয়, নাটকের গল্প, চরিত্র, সংলাপ—সবই যেন মার্ক জাকারবার্গের নীল দুনিয়া থেকে টুক করে উঠে এসেছে। বড় বেশি ট্রেন্ডি আর একঘেয়ে। তানভীর তাঁর গল্পের মূল চরিত্র হিসেবে এমন একজনকে বেছে নিয়েছেন, যাঁকে ফেসবুকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই শহরে মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পঙ্ক্তি থেকে ধার করা নাটকটার নাম বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো।
তাইলে সেই কথাই রইল একটু হালকা মুড নিয়ে দেখা ভালো। নির্মাতা অনম বিশ্বাস আয়নাবাজির চিত্রনাট্যকার বলেই তাঁর ওপর বিশ্বাস ছিল। যদিও এই ‘হাসির নাটক’ দেখতে বসে হাসার জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে, তবু একটা নতুন কিছু বানানোর চেষ্টা দিন শেষে অস্থির সময়ে স্বস্তিই দিল।