আনোয়ার হোসেনকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিশিষ্ট অভিনেতা আনোয়ার হোসেন আর নেই। তিনি গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ পর্যন্ত তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় অর্ধসহস্র চলচ্চিত্রে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চরিত্রে অভিনয় করে পান দারুণ জনপ্রিয়তা। কাজ করেছেন টিভিতে এবং মঞ্চে। তাঁর অভিনীত যাত্রাপালা নবাব সিরাজউদ্দৌলা এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। চলচ্চিত্রের এই বিশিষ্ট অভিনেতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের কয়েকজন সহকর্মী। চলচ্চিত্রের শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা গতকাল দুপুরে এফডিসিতে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্রের ছবি আর শেষ শ্রদ্ধা জানানোর কিছু আলোকচিত্র দেওয়া হলো এখানে।

আনোয়ার হোসেন (৬ নভেম্বর ১৯৩১-১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩) ষ ছবি: সংগ্রহ
আনোয়ার হোসেন (৬ নভেম্বর ১৯৩১-১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩) ষ ছবি: সংগ্রহ

আনোয়ার হোসেন এখন শুধুই স্মৃতি: রাজ্জাক
আনোয়ার হোসেনের মতো মানুষ হয় না। আমরা একসঙ্গে অসংখ্য ছবি করেছি। প্রথম কাজ করেছিলাম আবির্ভাব ছবিতে। তাঁর মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকে অসংখ্য স্মৃতি এসে মনের মাঝে ভিড় করছে। কোনটা রেখে কোনটা বলব। আনোয়ার হোসেন এখন শুধুই স্মৃতি। তিনি খুব অভিমানী ছিলেন। শুনেছিলাম, চিকিৎসার জন্য তাঁকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই সুযোগ আর তিনি দেননি।

বাংলার নবাবের জনপ্রিয়তা দেখেছিলাম সেদিন: সুচন্দা
আনু ভাইয়ের (আনোয়ার হোসেন) সঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর মধ্যে অন্যতম জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া। ছবিতে আনু ভাই ছিলেন একজন সাংবাদিক ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ আর আমার ভাই। জীবন থেকে নেয়া ছবির শুটিংয়ের জন্য ট্রেনে চড়ে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছি। মাঝপথে কী কারণে যেন ট্রেন থামে। এরই মধ্যে আশপাশে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ওই ট্রেনে আনোয়ার হোসেন আছেন। তখন আনু ভাই নবাব সিরাজদ্দৌলা ছবিতে ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’ চরিত্রে অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়। মুহূর্তে পুরো এলাকায় লোকজন জড়ো হয়ে যান। তাঁরা কিন্তু সেদিন আনোয়ার হোসেনকে দেখতে আসেননি, এসেছিলেন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দেখতে। বাংলার নবাবের জনপ্রিয়তা দেখেছিলাম সেদিন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা
নবাব সিরাজউদ্দৌলা

আনু ভাই মনেপ্রাণে একজন শিল্পী ছিলেন: ববিতা
আনু ভাই মনেপ্রাণে একজন শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রে অনেকেই কাজ করেন জীবনের প্রয়োজনে। কিন্তু আনু ভাই অভিনয় করতেন অভিনয়কে ভালোবেসে। আমার সৌভাগ্য যে, আমি আনু ভাইয়ের সঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে কাজ করেছি। সুভাষ দত্ত পরিচালিত অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবিতে আমি তাঁর নায়িকা ছিলাম। এরপর তাঁর সঙ্গে লাঠিয়াল, গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমণি, সূর্যগ্রহণ, সূর্যসংগ্রাম, আলোর মিছিলসহ অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছি। কোনো ছবিতে শট দেওয়ার পর আমার অভিনয় সম্পর্কে যখনই আনু ভাইকে জিজ্ঞেস করতাম, তিনি বলতেন, ‘ভাবা যায় না, তুই অনেক ভালো অভিনয় করেছিস।’ আনু ভাইকে কখনো ভুলতে পারব না। তিনি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন।

‘আলেয়া’ চরিত্রে আমার অভিনয় করার কথা ছিল: কবরী
আনোয়ার হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে ক খ গ ঘ ঙ ছবির শুটিং করতে চুয়াডাঙ্গায় গিয়েছিলাম। তখন একসঙ্গে বেশ কয়েক দিন আমরা থেকেছি। আমরা খেতে বসতাম একসঙ্গে। অভিনয়ের বাইরে তিনি ছিলেন খুব প্রাণবন্ত একজন মানুষ। উচ্চ স্বরে হাসতেন। খুব মজা করতেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছি। কিন্তু একটি ছবিতে অভিনয় করতে না পারার দুঃখ আমার কোনো দিন ঘুচবে না। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবির ‘আলেয়া’ চরিত্রে আমার অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু পরে আর ওই ছবিতে আমার কাজ করা হয়নি। বাস্তবের নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দেখিনি, কিন্তু আনোয়ার ভাই যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে অভিনয় করতেন, মনে হতো তিনিই যেন সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আনোয়ার হোসেনের মতো মানুষ কখনো হারাবে না। মানুষের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন।

পালংক
পালংক

তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দারুণ ভক্ত: আমজাদ হোসেন
আনোয়ার হোসেন ভাই আর আমাদের বাড়ি ছিল জামালপুর শহরে। তাঁর ছোট ভাই সালেহ ছিল আমার বন্ধু। সালেহ হঠাৎ মারা যায়। এরপর আমি হয়ে যাই আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই। ওই সময় প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই জামালপুরে আনোয়ার হোসেনের বাড়ির বারান্দায় আমাদের আড্ডা হতো। আড্ডার বিষয় ছিল ‘কল্লোল যুগ আর রবীন্দ্রনাথ’। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দারুণ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। এরপর আমরা ঢাকায় আসি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, তার বেশির ভাগেই অভিনয় করেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যে কয়টি নির্ভরযোগ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, তার প্রায় সব কটিতেই তিনি অভিনয় করেছেন। আর আমি যখন চলচ্চিত্র তৈরির পরিকল্পনা করতাম, তখন তাঁকে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে পারতাম না। তাই তো দু-একটি বাদে আমার সব ছবিতেই অভিনয় করেছেন তিনি।

গানটি পর্দায় অন্য রকম আবেদন তৈরি করেছিল: সৈয়দ আব্দুল হাদী
আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল বড় ভাই আর ছোট ভাইয়ের মতো। তিনি বিভিন্ন ছবিতে আমার গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন। তার মধ্যে গোলাপী এখন ট্রেনে ছবিতে আমার গাওয়া ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার’ গানটিতেও ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই অনবদ্য অভিনয় আর আমজাদ হোসেনের অসাধারণ নির্মাণশৈলী পর্দায় এক অন্য রকম আবেদন তৈরি করেছিল। গানটির জন্য আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলাম। চলচ্চিত্রের গানের ব্যাপারটাই আসলে এমন। শিল্পী গানটি গাওয়ার পর অভিনেতা বা অভিনেত্রী তাঁদের অভিনয়গুণে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে অন্য মাত্রা যোগ করেন।

সূর্যস্নান
সূর্যস্নান

তিনি ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর আমি মোহন লাল: প্রবীর মিত্র
বাংলা চলচ্চিত্রের একটি তারা আজ নিভে গেল। এমন একটি তারা আর কত শত বছর পরে আবার জন্মাবে, আদৌ জন্মাবে কি না, তা কেউ জানি না। তাঁর সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যাত্রাপালার অসংখ্য প্রদর্শনীতে আমি অংশ নিয়েছি। সবগুলো প্রদর্শনীতেই তিনি ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর আমি মোহন লাল।
অনুলিখন: মনজুর কাদের, ছবি: সাহাদাত পারভেজ