‘আমাকে বোন বলে সম্বোধন করতেন’
‘শুনুন, পদ্মা নদীর মাঝি আর টার্গেট–এ আপনার কাজ আমি দেখেছি। আপনার অভিনয় আমার ভালো লেগেছে। আমি লাল দরজা নামে একটি ছবি করছি। আপনি প্রধান চরিত্র করবেন। রাজি আছেন? থাকলে আজই সংবাদ সম্মেলন করব। আপনার নাম বলব।’
টেলিফোনে নামটা শুনেই ভয় আর আবেগে আমার হাত কাঁপা শুরু করেছিল। আগেও তো গৌতম ঘোষ, সন্দীপ রায়ের ছবিতে কাজ করেছি, কখনো এমন হয়নি। খুশিতে কথা পর্যন্ত গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না। কোনো রকমে খালি একবাক্যে বললাম, রাজি। ছোট করে তিনি আমাকে গল্পটা শোনালেন। বললেন, ‘আপনার চরিত্রটার জন্য স্বতন্ত্র কিছু মুখভঙ্গি দরকার হবে। চাহনি আর ঠোঁটের ভঙ্গি দিয়ে হৃদয়ের বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।’ আরও কী সব বললেন, উত্তেজনায় কিছুই শুনিনি। শুধু বললাম, আপনার সিনেমায় অভিনয় করতে চাই। আর বেশি কিছু জানতে চাই না। পরে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি আমাকে কাস্ট করেছেন।
শুটিংয়ে গিয়ে দেখি গুরুগম্ভীর এক মানুষ। কথাবার্তা চাছাছোলা। সে জন্য প্রথম দিকে কথা বলতেও ভয় লাগত। দূরে দূরে থাকতাম। কিছুদিন কাজ করে বুঝলাম, বাইরেটাই খালি শক্ত, ভেতরে আসলে হাসিখুশি ও সাদা মনের একজন মানুষ। আলাপ শুরু করলে আর থামতেন না। বেশির ভাগ সিনেমা এবং খাবারের গল্প। আর ঘুরে ফিরে আসত ইলিশের কথা।
তবে সম্পর্ক যত হাশিখুশিই থাক, কাজে কিন্তু কখনো ছাড় দিতেন না। শুটিং করতে গিয়ে কত যে ধমক খেয়েছি। তিনি চাইতেন সব সময় চরিত্রের মধ্যে থাকি। মাঝেমধ্যে শুটিংয়ের ফাঁকে হেসে উঠতাম। কখনো কারও সঙ্গে হয়তা আলাপে মশগুল হয়ে যেতাম। তিনি রাগ করতেন, বুঝিয়ে বলতেন, চরিত্রের বাইরে মনটা থাকলে কাজে শতভাগ মনোযোগ থাকে না। চিত্রনাট্যের আবহে থাকলে কাজটা ঠিকঠাক হয়। শুটিংয়ে আড্ডা সহ্য করতেন না।
একবার হয়েছে কী, একটা দুঃখের দৃশ্য ধারণের আগে কী কারণে যেন খুব জোরে হেসে উঠেছি। এ অপরাধে কয়েক ঘণ্টা শুটিং বন্ধ করে রাখলেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি চরিত্রের বাইরে চলে গেছ। যাও, কিছুক্ষণ একা থাকো। কারও সঙ্গে কোনো কথা বোলো না।’ ডাবিংয়ের সময়েও তাঁর কড়া নিষেধ ছিল, ঘুম থেকে উঠে কোনো কথা বলা যাবে না। ঘুম থেকে উঠেই ডাবিংয়ে চলে আসতে হবে। কষ্ট বা দুঃখের জায়গাগুলোর ডাবিং আগে করতেন। এগুলো পরে আমার কাজের ধরনটাকেই বদলে দিয়েছিল।
‘লাল দরজার’ (১৯৯৭) পর থেকে তো আমাদের পারিবারিক সম্পর্কই হয়ে গেল। সেই থেকে আমাদের দুই পরিবারের যাওয়া–আসা। আমাকে বোন বলে সম্বোধন করতেন। কলকাতায় যাওয়ার আগে প্রতিবার তাঁর পছন্দের বাংলাদেশের ইলিশ ও খেজুরের গুড় নিয়ে যেতাম। আমি গেলেই শর্ষে ইলিশ খাওয়াতেন। নিজে পাতে মাছ তুলে দিতেন। ফেরার সময় আমার পছন্দের উড়িষ্যার গামছাসহ অনেক কিছু দিয়ে দিতেন।
পরে সম্পর্কটা এমন গভীর হয়ে উঠল যে একসময় আমার মেয়ে এশা আর দাদার মেয়ে শিউলিকে একই সঙ্গে কানাডায় পড়তে পাঠাই। তারাও এখন খুবই ক্লোজ। তবে লাল দরজার পরে তাঁর সঙ্গে আর কোনো কাজ করা হয়নি। অনেকেই জানতে চান, কেন? আসলে কখনোই কাউকে ভেবে গল্প বাছাই করতেন না দাদা। বরং গল্পে যাকে মানানসই মনে হতো, তাকেই নিতেন। বহুবার বলেছেন, গল্প ডিমান্ড করলেই আমাকে ডাকবেন। এই নিয়ে আমার আফসোস নেই। ভালো একজন মানুষের সৌহার্দ্য পেয়েছি, এই বা কম কী।
অভিনয়শিল্পী হিসেবেও তাঁর কাছে আমার অনেক ঋণ। খুব কাছ থেকে তাঁর সঙ্গে কাজ করে কথা বলে সিনেমা ও অভিনয় বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি। এগুলো আমার শিল্পীজীবনের প্লাস পয়েন্ট। শুধু তা–ই নয়, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা পরামর্শ দিতেন।
দাদা সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সকালে চিরতার রস খেতেন। নিয়মিত যোগব্যায়াম করতেন। এসব নিয়ম আমাদেরও মেনে চলতে বলতেন। করোনার মধ্যেও কথা হতো। বলতেন, নিরাপদে থেকো। কয় মাস আগেই সর্বশেষ কথা হয়েছে। তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছিল অনেকটাই সুস্থ এখন। বলতেন, কত দিন তোমাকে দেখিনি। করোনা কমলে এসে দেখা করে যেয়ো। ভেবেও ছিলাম করোনা পরিস্থিতি একটু ভালো হলেই দেখা করে আসব। সেই সুযোগ আর হলো না।
অনুলিখন: মনজুরুল আলম, ঢাকা