আয় বৃষ্টি

আয় বৃষ্টি
আয় বৃষ্টি

আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টি নামলে মানুষজন ঝড়ের বেগে যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। আমিও দৌড় শুরু করতেই সুগন্ধ আমার হাত চেপে ধরল, ‘কী ব্যাপার, পচার বাপ! তুমি না বৃষ্টি নিয়ে কী সুন্দর কবিতা লিখে পাঠাও আমাকে! “এই সুমহান বর্ষায় ভেসে যাচ্ছি দুজনে”, এই রকম। এখন বৃষ্টি দেখে দৌড় দিচ্ছ কেন?’ সুগন্ধকে কী করে বোঝাই বৃষ্টি শুরু হলে আমি হাতে একটা চায়ের কাপ নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, ‘এই দুর্নিবার বর্ষণে শুদ্ধ হচ্ছে প্রকৃতি, ভিজে যাচ্ছি আমিও!’ আসলে সত্যি সত্যি বৃষ্টিতে ভিজলে আমার সর্দি থাকে তিন দিন। এমনকি ইদানীং বৃষ্টি দেখলেই আমার গায়ে ভূমিকম্প দিয়ে জ্বর আসে! আমি সুগন্ধকে বললাম, ‘এবারের মতো মাফ করে দাও। আমি বৃষ্টিতে ভিজতে পারব না। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি একলা একলা ভিজতে পারো।’সুগন্ধ নাছোড়বান্দা, ‘আজকে তোমাকে ভিজিয়েই ছাড়ব, পচার বাপ! বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর না ওঠা পর্যন্ত তোমার মুক্তি নেই।’আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মিনমিন করে বলতে চেষ্টা করি, ‘একটা ছাতা বা রেইনকোট হলে ভিজতে সুবিধা হতো! ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার মজাই আলাদা! আরেক দিন ছাতা নিয়ে এসে তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব। আজকে বাসায় চলে যাই।’ সুগন্ধ আমাকে ছাড়ে না। আমার হঠাৎ  করে রাগ উঠে যায়, ‘এখন বলবে বৃষ্টিতে ভেজো। কিছুক্ষণ পরে বলবে গাছে উঠে দুইটা কদম ফুল পেড়ে এনে চুলে গুঁজে দাও! এতসব আহ্লাদ আমার ভালো লাগে না। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি ভিজতে থাকো।’আমি সুগন্ধর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াই। ও একলা একলা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। আহা, কাউকে অনেক আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখার একটা অন্য রকম অনুভূতি আছে। আমি মনে মনে এই দৃশ্যের ওপর একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করি!একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, হঠাৎ  একটা খোঁচা খেয়ে আমার ধ্যান ভাঙে। একটা বাচ্চা মেয়ে আমার হাত ধরে টানছে, ‘আফায় কইছে এই ফুল দুইটা রাইখা দশটা ট্যাকা দিতে।’ মেয়েটির হাতে দুটি কদম ফুল। কদম ফুল দেখেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি মেয়েটাকে ধমক দিলাম, ‘তোর আপার কাছে গিয়ে ফুল দিয়ে আয়। আমার কাছে টাকা নাই। আমি এক টাকাও দিতে পারব না।’মেয়েটা দৌড়ে আমার সামনে থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ফুলগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধরেন, এই ফুল দুইটা আপনে রাখেন। আফায় আমারে বিশ ট্যাকা দিয়া কইছে ফুলগুলা আপনেরে দিতে।’আমার মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ল। আমি ফুলগুলো রাস্তায় ছুড়ে মারলাম। আমার ভীমমূর্তি দেখে মেয়েটা আবার দৌড়ে চলে গেল।আমার হঠাৎ  করে মনে হলো, কোথায় কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। আমি সুগন্ধর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। ওর চোখের কোনা দিয়ে যেটা নামছে, সেটা কখনোই বৃষ্টির জল হতে পারে না। আমি ওর চোখের জল চিনি। ওর চোখ থেকে জল বেরোলে আমার বুকের ভেতর কেমন জানি হতে থাকে। আমি ওকে বললাম, ‘কদম ফুল ফেলে দিয়েছি দেখে কাঁদছ? দাঁড়াও, আমি এখনই তুলে নিয়ে আসছি। দরকার হলে একটা কদমগাছ খুঁজে বের করে সব ফুল তোমার জন্য নিয়ে আসব।’ সুগন্ধ মাথা নাড়ায়, ‘কদম ফুল লাগবে না। ওগুলোর জন্য আমার মন খারাপ হয়নি।’ ‘তাহলে তুমি কাঁদছ কেন? তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজছি না বলে কাঁদছ?’ সুগন্ধ কিছু বলে না, ‘বৃষ্টিতে না ভিজলেও কোনো সমস্যা নেই। তুমি আমার পাশে আছ, এটাই আমার বড় শান্তি। তোমাকে যে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এটাই আমার সবচেয়ে আনন্দ।’আমি অবাক হলাম, ‘তাহলে তোমার কী হয়েছে?’সুগন্ধ হাসে, এই যে তুমি-আমি, এই কদম ফুল, এই বৃষ্টি, এটাই বাস্তব। এটাই বর্তমান। আমরা সারা জীবন এ রকম একসঙ্গে থাকতে পারব কি না, সেটা আমরা জানি না। এই বৃষ্টিটা কত নিশ্চিত, তাই না? অথচ এ রকম কোনো এক বৃষ্টির দিনে আমি তোমার পাশে থাকব কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভবিষ্যৎ টা কত অনিশ্চিত, খেয়াল করেছ?’ আমার হঠাৎ  করে বুকের ভেতর কেমন জানি করে ওঠে। এই সময়টা আমরা হয়তো আর কখনোই ফিরে পাব না। এই বৃষ্টিটা হয়তো সব সময় এ রকম থাকবে, কিন্তু আমরা হয়তো এ রকম থাকব না। সুগন্ধের চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকে। একসময় বৃষ্টি এত জোরে নামতে থাকে, আমি চোখের জল আর বৃষ্টির জল আলাদা করতে পারি না। আমার চোখও ঝাপসা হয়ে আসে।

চট্টগ্রাম