একসঙ্গে খাওয়ার আনন্দ আলাদা

মহড়ায় প্রাচ্যনাট নাট্যদলের কর্মীদের একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া
মহড়ায় প্রাচ্যনাট নাট্যদলের কর্মীদের একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া

শিল্পকলা একাডেমিতে মহড়ার বিরতিতে খাবারের আয়োজন চলছে। শোনা গেল আজ এফডিসি থেকে খাবার আসবে। বাতাস সবার নাকে যেন কালাভুনার খানিক ঘ্রাণ লাগিয়ে দিল। অবশেষে পৌঁছাল এফডিসির খাবার। জিজ্ঞাসা করা হলো, কে কী খাবেন? প্রায় সবাই একসঙ্গে বললেন, ‘আমরা সবাই গরু।’ অর্থাৎ তাঁরা সবাই গরুর মাংস খাবেন। নাটক মহড়ার বিরতিতে এফডিসির কালাভুনা নিয়ে কাড়াকাড়ির এই কথাগুলো দেশনাটক-এর সদস্য সোমা ফেরদৌসের।

মঞ্চনাটকে মিছেমিছি খাওয়াদাওয়া করেন অভিনয়শিল্পীরা। সে খাওয়াই কেমন জীবন্ত হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে। তবে তাঁদের বাস্তব খাওয়াদাওয়া কেমন? পর্দার ঠিক পেছনে, মহড়ার বিরতিতে, প্রদর্শনীর আগে গ্রিনরুমে, চায়ের আড্ডায়—কী করেন তাঁরা? কী খান? কীভাবে খাবার পৌঁছে যায় তাঁদের কাছে? পর্দার পেছনের সেই খাওয়াদাওয়ার বয়ান নিয়ে এ আয়োজন।

কোথায়, কীভাবে খাওয়াদাওয়া হয়?

শিল্পকলার মহড়াকক্ষে কিংবা গ্রিনরুমে খাওয়াদাওয়া করেন নাট্যকর্মীরা। কখনো কখনো যাওয়া হয় পাশের চিটাগাং হোটেলে। তবে মহড়ার ফাঁকে সময় বাঁচাতে মহড়াকক্ষেই খাবার খান তাঁরা। থিয়েটার দলের সদস্য পলাশ হেনড্রি সেন বলেন, ‘মহড়ায় সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাইরে হোটেলে খেতে গেলে সময় চলে যায়। তা ছাড়া সবাই একসঙ্গে খেতে যে মজা হয় তা হোটেলে খেলে পাওয়া যায় না।’ শিল্পকলায় নাশতার জন্য খাবার পাওয়া যায় জাতীয় নাট্যশালার চিলেকোঠায়, মাঠের উত্তর দিকে কফি হাউজে, শিল্পকলার বাইরে চায়ের দোকানে। ভারী খাবার পাওয়া যায় শিল্পকলার ক্যানটিনে। কখনো প্যাকেটজাত খাবার আনা হয় বাইরের হোটেল থেকে। খাবার পাওয়া যায় জাতীয় নাট্যশালার নিচে রেস্টুরেন্টে। তবে নাট্যকর্মীরা উৎসব বা বড় অনুষ্ঠানে, নতুন নাটকের মহড়ায় খাবার আনেন এফডিসি থেকে।

যেন পিকনিক

খাওয়াদাওয়া বড় কথা নয়। একসঙ্গে খাওয়ার আনন্দই সব। একসঙ্গে খেলে যেন পিকনিকের আমেজ পাওয়া যায়। অনেক কথা ভাগাভাগি হয়। কেউ কোনো বিশেষ খাবারে অভ্যস্ত হলেও সবার সঙ্গে খেয়ে যান। কোনো অভিযোগ নেই। আবার কারও বেশি খাওয়া নিয়ে রসিকতা করতেও ছাড়েন না কেউ কেউ। এর মধ্যে কখন যে খাওয়া হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। বললেন পলাশ হেনড্রি সেন।

তাকিয়ে থাকি, কখন বিরতি হবে

একটানা মহড়ায় শরীর তৈরিতে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়, খাটুনিও অনেক। কখন বিরতি হবে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন অভিনেতারা। মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের বাহার সরকার বলেন, ‘আসলে এর অনুভূতিটাই আলাদা। কারণ, একটানা মহড়ায় বেশ পরিশ্রম করতে হয়। তাকিয়ে থাকি কখন বিরতি হবে। এরপর বিরতির সময়টুকু সবচেয়ে আনন্দের সময় মনে হয়। খাবার দেওয়া হলে সবাই মিলে খাই। এটা বেশ ভালো লাগে।’ দেশ নাটক-এর সদস্য সোমা ফেরদৌসের গলায়ও শোনা গেল একই কথা। ‘সকাল থেকে মহড়া থাকে। মহড়ার মাঝে সবাই তাকিয়ে থাকি, কখন বিরতি হবে? তবে মজার বিষয় হলো মহড়ায় একটি শব্দ আমি উচ্চারণ করতে পারছি না। খাওয়ার সময় সবাই মিলে সেটা নিয়ে আমার সঙ্গে মজা করল। এটা আরেক ধরনের মজা। এরপর খাবার সময় হলেই আমরা নির্দেশকের কাছে এমন একটা ভাব করি যেন খিদেয় খুব কাতর। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে খাবার নিই। সেখানে কে আগে যাবে এগুলো নিয়েও মজা হয়।’

টাকা তুলে খাওয়াদাওয়া

 কখনো কখনো টাকা তুলেও খাবার আসর বসে মহড়াকক্ষে। প্রাচ্যনাট স্কুল অব অ্যাকটিং অ্যান্ড ডিজাইনের কো-অর্ডিনেটর সোহেল রানা বলেন, ‘আসলে আমাদের সবকিছু তো প্রদর্শনী ঘিরে। সাধারণত যাঁরা থিয়েটার করেন, তাঁদের পকেটের অবস্থাটা একটু দুর্বল থাকে। মহড়ার ফাঁকে টাকা উঠিয়ে খাওয়াদাওয়া করি। খাওয়াদাওয়াই বড় কথা নয়, একসঙ্গে টাকা উঠিয়ে খাওয়ার মজা আলাদা। শুধু তা-ই নয়, কারও বিশেষ দিনে তাঁকে না জানিয়ে পার্টিও দিই।’

কাড়াকাড়ি-মারামারি

খাবার খেতে খেতে কারও প্লেট থেকে কোনো কিছু কেড়েও খেয়ে নেন মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের বাহার সরকার। তিনি বলেন, ‘খাওয়াদাওয়ার মধ্যে শিঙাড়া-সমুচা দেওয়া হয়। সবাই মিলে খাই। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করি। আরেকজনেরটা খেয়ে ফেলি।’ প্রাচ্যনাটের সদস্য সোহেল রানা বললেন, ‘খাওয়াদাওয়ার সময় কাড়াকাড়ি তো মজার জিনিস। একজনের খাবার অন্য কেউ খেয়ে ফেলল। এর জন্য আরেকজন রাগ করল, কেউ কেঁদেই ফেলল। তখন যে খেয়েছে তাকে বকা দিই। কিন্তু দেখা যায় পরের দিনও একই কাহিনি ঘটেছে।’

অস্থিরতায় খাওয়া বন্ধ

সাধারণত প্রতিটি প্রদর্শনীর আগেই অভিনয়শিল্পীদের হালকা নাশতা দেওয়া হয়। তাঁর মধ্যে শিঙাড়া, সামুচা আর চা থাকে। কিন্তু প্রদর্শনীর আগে অস্থিরতায় খাওয়া ঠিকভাবে হয়ে ওঠে না। বাহার সরকার আরও বললেন, ‘প্রদর্শনীর আগেও আমাদের নাশতা দেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময় অস্থিরতায় খাওয়াটা তেমন হয় না। পরিবেশনা ভালো হলে প্রদর্শনী শেষে খেতেও ভালো লাগে।’

খাওয়াও কাজের অংশ

 নতুন নাটকের কাজে ব্যস্ততায় অনেক সময় খাওয়ার ফুসরতও থাকে কম। সেট বানাও, রং করো, প্রপস বানাও, মুখোশ বানাও আরও কত-কী! কাজের ফাঁকে চলে সংগীত। তার ফাঁকেই খাওয়ার সময় এলে চলে খাওয়াদাওয়া। আলাদা সময় নেই। প্রাচ্যনাটের সোহেল রানা আরও বলেন, ‘আমাদের সেট বানাতে টানা চার-পাঁচ দিন কাজ করতে হয়। সে সময় আমরা কাজ করতে করতেই খাই। খাওয়াটা কাজের অংশ হয়ে যায়।’