এক রহস্যময়ী অভিনেত্রী

কবরী
কবরী

এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু...
গানটি আমার বড়ই প্রিয়। সেই ছোটবেলায় আমার মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা সিনেমার গান। ছবিটি দেখেছিলাম চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস হলে।
বাবা আগেই টিকিট কেটে রেখেছেন। মাকে বলা হয়েছে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে। আমার মায়ের কোলে তখন ছোট্ট একটা ভাই। তার বড় আমি। সুতরাং আমি একটু বড়। তাও সেটা আমার অভিনীত সুতরাং ছবির আগের কথা। আমার আবদার, আমিও সিনেমা দেখব, যদিও আমার সিনেমা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না সেই সময়।
অবশেষে মায়ের সঙ্গে সিনেমা দেখা। হলে ঢুকতেই অন্ধকার। ছবি শুরু। কেমন যেন লাগছে। ভয় ভয়। কিছুটা উত্তেজনা। সিনেমার লোকগুলো আমাকে কি লক্ষ করছে? আরও কত কী ভাবছি। কিছুক্ষণ পর এরই মধ্যে হলে আলো জ্বলে উঠল। বাবা চিনেবাদামের প্যাকেট আর একটা সিনেমার গানের চটি বই কিনে আনলেন। মার বড় সিঁদুরের টিপপরা চেহারাটাও খুশি খুশি হয়ে উঠল। আমারও বেশ মজা লাগছে। নিজেকে বড় বড় মনে হচ্ছিল।
টিং, টিং, টিং, টিং ঘণ্টি বেজে উঠল। আবারও সেই ভুতুড়ে অন্ধকার। সিনেমা শুরু। এবার আমার আগ্রহ বাড়তে লাগল। নায়িকার কী সুন্দর চেহারা! কিন্তু তার সঙ্গে লোকটির কেমন যেন বেশি বয়স। অনেক পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, সুচিত্রা সেন ও অশোককুমার ছিলেন হসপিটাল ছবির নায়ক-নায়িকা। লেখার শুরুতে ব্যবহার করা বিখ্যাত গানটি ছিল তাঁদের লিপসিং-এ গাওয়া প্রেমের গান। সেই গানটি আজও আমার বড় প্রিয়।
তারপর কত ছবি দেখেছি সুচিত্রা সেনের! ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’ শুনে মনে হতো, গানের কথাগুলো কী গভীর ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছে মনটা!।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে ষাট, সত্তর দশক পর্যন্ত সুচিত্রা-উত্তম জুটি বাঙালি সমাজে কী আলোড়ন তুলেছিল, তা কি এখন নতুন প্রজন্মের মানুষদের বোঝানো যাবে? কলেজপড়ুয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ভেতরে সুচিত্রা-উত্তমকেই ধারণ করত। সুচিত্রা সেনের হাসির তুলনা কি মেলে? ছবিতে সুচিত্রা-উত্তম জুটির গান মানেই হিট। শুধু হিট নয়, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
অভিনয়, সংলাপ বলার স্টাইল, সবকিছু মিলিয়ে সুচিত্রা ছিলেন স্রষ্টার নিখুঁত কারুকার্য। অনেক যুগ পর এমন করে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসে সৃষ্টির রহস্য জানান দিয়ে যায় বিরল কিছু মেধা। সময় ও সৃষ্টি দুটিতে মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে যায়, তখনই রহস্যের উন্মোচন ঘটে। এই রহস্যের ভেতর-বাইরে এক মাকড়সার জালের সৃষ্টি হয়। শুরু এবং শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। সুচিত্রা সেনের অভিনয়শৈলী দর্শকদের শুধু চিত্ত বিনোদনে সহায়ক ছিল না, এক অদ্ভুত সম্মোহনী আকর্ষণ ছিল তাঁর। তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে ছিল ঈর্ষণীয় মাদকতা। প্রতিটি ছবির চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর প্রেমের দৃশ্যগুলোতে কী প্রচণ্ড রোমাঞ্চকর অভিনয় করতেন, উফ! তা বলে বোঝাতে পারব না।
নন্দিত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন পৃথিবীর নন্দনকাননে বোদ্ধা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে সারা জীবন এক রহস্যময়ী অভিনেত্রী হিসেবে বেঁচে থাকবেন। নরম স্নিগ্ধ পিদিমের আলোর মতো আলোয় আলোয় ভরিয়ে দেবেন—এই আমার বিশ্বাস।
শ্রীমতী সুচিত্রা সেনের জন্য আমার প্রণতি ও নিখাদ ভালোবাসা।
 ৬০ ও ৭০ দশকে ঢাকার ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়িকা