কেমন আছেন সেই পুতুল

হোসনে আরা পুতুলকোলাজ

‘আমারও বিবাহের আলাপ চলতাছে। চেহারা ছবি সুন্দর হওনে যে বিপদে পড়ছি। খালি সম্বন্ধ আসে।’ হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘আগুনের পরশমণি’তে হোসনে আরা পুতুলের বলা এই ডায়ালগ আজও ভাইরাল হয়। ছবির সাবলীল অভিনয় তাঁকে এনে দেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেই পুতুল এখন অভিনয়ে অনিয়মিত। জানালেন, অভিমান এবং ব্যক্তিগত কারণে অভিনয় থেকে দূরে আছেন।
‘আগুনের পরশমণি’র শুটিংয়ের সময় পুতুলের এসএসসি পরীক্ষা থাকায় মনে কোনো আনন্দ ছিল না। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘একটি দৃশ্য শেষ করেই বই নিয়ে বসতে হয়েছে। শুটিংয়ের ফাঁকে একটু ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই আসাদুজ্জামান নূর আঙ্কেল, বিপাশা হায়াত আপারা ধমক দিয়ে বলতেন, এই, বই নিয়ে বসো। মন খারাপ করে মেকআপ রুমে পরীক্ষার পড়া নিয়ে বসতাম।’

অভিমান এবং ব্যক্তিগত কারণে অভিনয় থেকে দূরে আছেন পুতুল
ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ূন আহমেদও একাধিকবার বলেছেন, পরীক্ষা জীবনের বিশাল ব্যাপার। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কোরো। কিন্তু পুতুলের কাছে মনে হয়েছে, এসএসসির চেয়ে বড় ‘আগুনের পরশমণি’। তিনি বলেন, ‘আমি পরীক্ষা দিতে চাইনি। পরীক্ষা বারবার আসবে, কিন্তু ‘আগুনের পরশমণি’ আর আসবে না। জোর করেই আমি ছবিতে ঢুকেছি।’ এত অনিয়মের পরেও অবশ্য পরীক্ষার ফলাফল বের হলে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণিতে পাস করেছেন পুতুল।

পুতুলের অভিনয়ে আসার গল্পটাও কম নাটকীয় নয়। তিনি জানান, নাট্যকার মতিউর রহমান গাজীপুরী তাঁর আত্মীয়। তাঁর সঙ্গে ১৯৯৩ সালে প্রথম বিটিভি সেন্টার দেখতে আসেন। বিটিভিতে ঘোরাঘুরি করতে করতে সহকারী পরিচালক হারুন মেহেদির সঙ্গে পরিচয়। হারুন সেদিন পুতুলকে জানান, হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটি নাটকের জন্য শিশু চরিত্র খুঁজছেন তাঁরা। তিনিই প্রযোজক বরকতউল্লাহর কাছে পুতুলকে নিয়ে যান। কিন্তু তার আগেই চরিত্রটিতে অন্য একজনকে নিয়ে নেন নির্মাতা।

১৯৯৩ সালে প্রথম বিটিভি সেন্টার দেখতে যার পুতুল
ছবি: সংগৃহীত

সেদিন একটি ফোন নম্বর দিয়ে নির্মাতার কাছে একটা অনুরোধ করেন পুতুল, যেদিন হুমায়ূন আহমেদ থাকবেন, সেদিন প্রিয় লেখককে দূর থেকে একনজর দেখতে চান তিনি। ঠিক আট দিন পরে ফোন আসে। আজ বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের দেখা পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন পুতুল। পুতুল বলেন, ‘আমি সবার আগে বিটিভিতে গিয়ে বসে ছিলাম। সেদিনই প্রথম দেখলাম আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফাসহ অনেক তারকাকে। কল্পনাও করিনি, তাঁদের কোনো দিন দেখতে পাব। সবাই রিহার্সালে যাচ্ছেন। এমন সময় দেখি, হুমায়ূন আহমেদ প্রবেশ করছেন। দেখে আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।’

পরে মহড়াকক্ষে যাওয়ারও সুযোগ হয় পুতুলের। তাঁকে পাণ্ডুলিপি দিয়ে বুঝিয়ে বলা হয়, চিত্রনাট্য পড়তে পড়তে ঝুমা চরিত্রের জায়গায় আসলে তাঁকে সংলাপগুলো বলতে হবে। অনুশীলনে সেই ডায়ালগ বলতেই হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘তুমি পাস।’ পাসের অর্থ তখনো বুঝতে পারেননি পুতুল। পরে সুবর্ণা মুস্তাফা তাঁকে বলেন, ‘তুমিও এই নাটকে কাজ করছ।’ পুতুল বলেন, ‘এভাবেই কোথাও কেউ নেই নাটকে সুযোগ পেয়ে যাই।’ সেটা অবশ্য অত গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্র ছিল না। হুমায়ূন আহমেদও তাঁর কথা ভুলে যান।

চলচ্চিত্রে পুতুল
ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরে তাঁর সঙ্গে আবার দেখা। ‘কবি’ নামে একটি ডকুমেন্টারি নাটকের শুটিং দেখতে এসেছেন পুতুল। প্রথমে তাঁকে চিনতেই পারেননি হুমায়ূন। শাড়ি পরে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে রাজকন্যা সেজে এসেছে। মাথার চুল হাঁটু ছুঁয়েছে। হুমায়ূনের কী খেয়াল হলো, বললেন, ‘এই মেয়ে, তোমার চুলগুলো কেটে কদমছাঁট করতে রাজি আছ?’ শুনে পুতুল অবাক, ‘কেন?’ হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে বলেন, ‘আমি ‘আগুনের পরশমণি’ নামে একটা ছবি করছি। সেখানে কাজের মেয়ের একটি চরিত্র আছে, রাজি হলে অভিনয়ের সুযোগ পাবে। ভাববার আধা ঘণ্টা সময় দিলাম।

২০১৫ সালের পরের তিন বছর কোনো কাজ করেননি
ছবি: সংগৃহীত

১০ মিনিটের মধ্যে পুতুল জানালেন, চুল ছাঁটতে রাজি। সেদিন হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পুতুল জানতে চাইলেন, ‘স্যার, চুল কতটুকু ছোট করব।’ তখন হুমায়ূন আহমেদ জানান, থাক, চুল ছোট করতে হবে না। এভাবেই ‘আগুনের পরশমণি’তে বিন্তি চরিত্রটা পেয়ে যান পুতুল। হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটক এবং তিনটি ছবিতে কাজ করেছেন এই অভিনেত্রী। হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে তাঁর জীবনের সেরা উপহারটা পেয়েছেন এই অভিনেত্রী। কী উপহার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার ছবি বানানোর গল্প নামে একটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছেন। আমার মতো নগণ্য মানুষ এর চেয়ে বড় উপহার জীবনে পাইনি।’

হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণের পরে অভিনয় থেকে দূরে সরতে থাকেন তিনি। ২০১৫ সালের পরের তিন বছর কোনো কাজ করেননি। সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। পুতুল জানালেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কিছু কাজ করলেও বড় মেয়ে পড়াশোনার জন্য অভিনয়ে সময় দিতে পারেননি। এই বছর এক ঘণ্টার একটি নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে কখনো ভাবেননি, অভিনয় থেকে দূরে আছেন। প্রিয় এই অঙ্গনে অনিয়মিত, কোনো অভিমান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি কিছুটা চুপ থেকে বলেন, ‘কী বলব, অভিমান তো আছেই। নিজেদের সঙ্গে আর অভিমান কী। অভিমান থাকলেও আমার বলার কিছু নেই। নিজেদের মধ্যে অভিমান করেই কী আর না করেই কী। এখন পরিবার নিয়েই ব্যস্ত।’ তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। সবাইকে নিয়ে তিনি গাজীপুরের জয়দেবপুরে থাকেন।

কখনো ভাবেননি, অভিনয় থেকে দূরে আছেন
ছবি: সংগৃহীত

আবারও অভিনয় করবেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া দূরে থাকা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। কারণ, অভিনয় প্রচণ্ড ভালোবাসি। চেয়েছিলাম, এই বছর থেকে নিয়মিত অভিনয় করব। করোনা কমলেই হয়তো শুটিংয়ে অংশ নেব।’