কোন তারাটা সেলিম ভাই?

১৪ জানুয়ারি ছিল নাট্যকার সেলিম আল দীনের মৃত্যুদিন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম

সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮), ছবি: প্রথম আলো
সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮), ছবি: প্রথম আলো

‘আপনি যহন উঁহু করছিলেন তহন বুঝি নাই যে আপনার সোন্দর কপালখানায় বিধি বুঝি এই নেকছিল। আমার নিগা কষ্ট হইছাল তহন? নিজের নিগাও না? যে মরে সে তার সমস্ত দুঃখ কয়বরের ভিতরে আটকাইয়া রাখে, আর অন্যজনা যে বাঁচে, সে কত দিক নিয়া যায়—এই গাতা বাড়ি-জোড়া বহু দিকে নিয়া যায় সে।’
প্রাচ্য নাটকের এই সংলাপ শুধু নোলকের জন্য সয়ফরের হাহাকারময় উচ্চারণ নয়, এ সংলাপ হয়তো জীবিত সব নাট্যপ্রেমী, শিক্ষার্থী, থিয়েটারবন্ধু, পরিবার-পরিজনসহ সব চেনা সৃষ্টির।

মৃত্যু নিয়ে সেলিম আল দীন বর্ণনা করেছেন তাঁর বহু নাটকে, বিভিন্ন লেখনীতে। যৈবতী কন্যার মন নাটকে কালিন্দীর মৃত্যুদৃশ্য ছিল রূপকথার মতো, কিংবা হাতহদাইয়ে পাণ্ডুর রোগে আক্রান্ত চুকন্নীর মৃত্যুর বর্ণনা পড়ে, শুনে বা দেখে দর্শকহৃদয় বারবার সিক্ত হয়েছে অসীম বেদনায়। কালিন্দীর মতো যৈবতী কন্যার মন নাটকের আরেক চরিত্র পরীও তো মারা যায়—মৃত্যুর সময় সে ধানী পান করে বনে গিয়ে। আর কিত্তনখোলার বনশ্রীবালা, অবশেষে সে-ও তো বরণ করেছিল মৃত্যুর অন্ধকার। হায়, বনশ্রীবালা...!

সেলিম আল দীনের মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা কারও জানা আছে কি না, জানি না। তবে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুর কাছে যখন নিজেকে সঁপে দিলেন তিনি, মনে আছে সেই সময় হাসপাতালে চিকিৎসকদের হতবিহ্বল মুখ; বন্ধু, শিক্ষার্থী, নাট্যজন, লেখক, শিল্পবন্ধুদের অশ্রুসিক্ত চোখ; ক্যামেরার ফ্ল্যাশ; সাংবাদিকদের অজস্র ছুটোছুটি।
সেলিম আল দীনকে নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্দেশে এগিয়ে চলে অজস্র বাহের গাড়োয়ান ও শুকুরচানের শব-শকট। সেই শব-শকটটি টেনে নিয়ে যায় লাল-সবুজের পতাকা আর হাজার খানেক হাত।
তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চিরচেনা প্রাণের ক্যাম্পাসে ফিরে এলেন নাট্যকার। চারপাশে তখন হিম হাওয়া-শীতের আবহ।

এ রকম এক শীতের সকালেই প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে। আমি সে সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ি। গাঢ় নীল রঙের প্যান্টের ওপর হালকা আকাশি শার্টের সঙ্গে হাতাকাটা সোয়েটার। দেখলাম ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ শিক্ষককে। হ্যাঁ, ১৯৭৯ সালে সেলিম আল দীনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম দেখা।
আর ২০০৮-এর শীতমাখা ভোরে তাঁর পরনে শুধু শ্বেতশুভ্র পোশাক। মুখে মৃতের বলিরেখা।

ক্যাম্পাসের সব মানব, বৃক্ষ, পাখি, জলাশয়গুলো এবং মুক্তমঞ্চ সেদিন যেন খুঁজছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সেলিম আল দীনকে—যে মানুষটির শব্দ-বাক্যের ছোঁয়ায় বাংলা নাটক হয়েছে সমৃদ্ধ, পেয়েছে নিজস্ব ভাষা ও দিক, সেই মানুষটি আজ ভাষাহীন!
১৯৮১ সাল। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগরের মুক্তমঞ্চের উদ্বোধন হলো তাঁর লেখা নাটক শকুন্তলার মাধ্যমে। সেই নাটকে আমি অভিনয় করেছিলাম কণ্ব চরিত্রে। ভোরের সূর্য উঠছে, আমরা অভিনয় করছি—এ অনুভূতি তো ভোলা যাবে না। আজ মনে হয়, আগামীকাল ভোরে নতুন যে সূর্য উঠবে, সেও কি খুঁজে বেড়াবে সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল সেলিম আল দীনকে?
কী ভয়ানক এক সুবিধাজনক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। কিছুই জানবেন না, বুঝবেন না, হাসবেন না, বলবেন না কিছু। এমনকি তাকিয়েও দেখবেন না। কিন্তু তাঁর জন্য আমাদের হৃদয় বারবার সিক্ত হবে; খণ্ডিত হবে প্রতিমুহূর্তে, প্রতিটি নাটকে, প্রতিটি সংলাপে, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে। আজীবন।

আবারও তাঁরই কণ্ঠস্বর। আবারও তাঁর নিঃশ্বাস। হয়তো তাঁর পদশব্দের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে দূরের আকাশ, মেঘ, ভোরের শিশির, জানা-অজানা বৃক্ষরাজি, ভরা জোছনার পূর্ণিমা এবং তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসের অতিথি পাখিরা। নতুন পাঠক, নতুন কোনো অভিনেতা বা পরিচালকও তো থাকবেন তাঁর প্রতীক্ষায়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে। জ্বলে ওঠে হাজার হাজার প্রদীপ, মোমবাতি-আলো-ছায়ায় ভাসে মানুষের মুখ। আকাশের দিকে তাকাই—আচ্ছা, কোন তারাটা সেলিম ভাই? যে হাতে ইশারা করে একদিন আকাশের তারা চিনিয়েছেন আমাদের, সেই হাত আর কখনো তারা চেনাবে না। এই বিশাল আকাশের কোথাও হয়তো নিজেই আজ ফুটে রয়েছেন তারা হয়ে!
‘মৃত্যু মানে সূর্যালোক থেকে লুপ্ত হওয়া। মিশে যাওয়া পলল মৃত্তিকায়।’ হায় সেলিম ভাই, হায় প্রাণের লেখক, হায় নাট্যাচার্য!
লেখক: অভিনয়শিল্পী, নির্দেশক