ক' ফোটা চোখের জল

মান্না দে। ছবি: খালেদ সরকার
মান্না দে। ছবি: খালেদ সরকার

আজ আমাদের যেন বড় বেশি কানে বাজছে তাঁর কফি হাউসের সেই আড্ডাটা... মনে বাজছে ক’ফোটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে...অর্ধশতক জুড়ে টানা কয়েক প্রজন্মকে যেসব অমল আবেগের গান পথ চিনিয়ে হাত ধরে নিয়ে চলেছে বাংলা ভাষাভাষীদের, কিশোর-তরুণ থেকে প্রৌঢ় কিংবা আরও পরিণতদের। এমনকি এই যে বর্তমানের হাইটেক প্রজন্ম যারা কানে ইয়ার-ফোন আর চোখ রাখে এলইডি স্ক্রিনে, তাদের বুকের ভেতরেও যে তাঁর সুর, তাঁর গানের সে গায়কীর কণ্ঠ-মাধুর্য। বাঙালি আর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যে কজন সংগীত-সাধককে ভালোবাসায় বুকে পুষে আসছে প্রজন্মে প্রজন্মে, মান্না দে যে তাঁর সবচেয়ে সামনের আসনটিতে বসে আছেন—এ কথা বুঝতে সংগীত সমালোচক কিংবা সংগীত বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সব মৃত্যু থেমে থাকা নয়। আজ ২৪ অক্টোবর ভোররাতে দেহান্ত হয়েছে সংগীতসাধক মান্না দের কিন্তু তাঁর প্রয়াণে তাঁর দেহান্তের শেষে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে তিন সহস্রাধিক সংগীতে সুরের যে আকাশ মান্না দে সৃজন করে গেছেন, সে আকাশে সূর্য হয়েই জেগে রইবেন তিনি।
আজ বেঙ্গালুরুর এক হাসপাতালে যখন তিনি চির-ঘুমের আয়োজন করছিলেন ভোররাতের সে গভীর থেকেই জেগে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাংলা সংগীতাকাশের বিষণ্ন সূর্য, প্রতি দিন যেমন জাগে। বয়স হয়েছিল, অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন; যাকে বলে জইফ হয়ে পড়া। বাংলাদেশ ও বাংলা থেকে সরে দূরপ্রবাসেই ছিলেন; আজ যেন আরও দূরতর প্রবাসে গিয়ে মায়া বাড়ালেন। এ যাওয়ায় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু কিন্তু যাওয়ার আগে বাংলার সংগীতকে তিনি যা দিয়ে গেছেন তার দিকে তাকাতে তাকাতেই আমাদের এক জীবন কেটে যাবে।

বাঙালি মানসে, সে কলকাতার এলগিন রোডই হোক কিংবা ঢাকার ওয়ারি, পার্ক স্ট্রিটের বনেদি বাড়ির ছোট ছেলেই হোক কিংবা ঢাকার গুলশান-বনানী বা পঞ্চগড়ের মফস্বল শহরতলির পান দোকানের দোকানি; সকাল কিংবা বিকেলে, সন্ধ্যা গোধূলি আর রাতের হাওয়ায় মান্না দের কণ্ঠ আজও যেমন বাজছে, যেমন হাওয়ায় উড়ছে তাঁর অননুকরণীয় সেই সুর-মাধুর্য, ভবিষ্যত্ জানে তা শতক ডিঙিয়েও অনশ্বর। বাংলা ভাষাভাষী সাধারণ মানুষ তাঁর কাছে পৌঁছেছে কানে শুনে সুরের টানে কথার ধ্বনিতে, শব্দের ছবি আঁকায়।

কলকাতায় নেমে ট্রামে-বাসে-পায়দলে কফি হাউস চিনেছেন এমন অনেকেই আজ বিখ্যাতজন, বিখ্যাত কবি, লেখক, সংগীতশিল্পী। কিন্তু বাঙালির সুরের আড্ডায় কফি হাউসটাকে প্রথম চিনিয়েছিলেন মান্না দে। আর সে চেনা সুরের প্রাণের আলোয় আমাদের পরিবারে, প্রেমে ও বন্ধুত্বে, প্রকৃতি, নগরে, নানা অনুষঙ্গে, নানা বোধে, সহস্রমুখ আবেগের মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ে, তাঁর গানে জেগে থাকবেন তিনি; মনে রইবেন আমাদের।