গানে গানে ৫০

এ আয়োজনের ছবিগুলো রুনা লায়লার ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে নেওয়া
এ আয়োজনের ছবিগুলো রুনা লায়লার ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে নেওয়া

উর্দু ছবি জুগনুতে রুনা লায়লা গান গেয়েছেন ১৯৬৫ সালের জুন মাসে। এরপর তিনি গেয়েছেন হাজার দশেক গান। গান গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি আর উর্দু ছবিতে। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ছয়বার। উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী তিনি। তাঁর সংগীতজীবনের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এবার। এ উপলক্ষে আনন্দে থাকছে দুই পাতার বিশেষ আয়োজন। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হয়েছে ‘গোল্ডেন জুবিলি সেলিব্রেশন অব রুনা লায়লা’ কনসার্ট। তার আগে কথা হলো রুনা লায়লার সঙ্গে। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় শিল্পীর সঙ্গে কথা বললেন মেহেদী মাসুদ ও মনজুর কাদের

রুনা লায়লা
রুনা লায়লা

নাচ দিয়ে শুরু
সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা প্রথম নাচ শিখেছিলেন। বাবা এমদাদ আলী ছিলেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। থাকতেন পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে মেয়েকে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করেন মা আমিনা লায়লা। এই প্রতিষ্ঠানে চার বছর নাচ শিখেছেন রুনা। শিক্ষক ছিলেন আফরোজা বুলবুল। রুনা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন কত্থক আর ভরতনাট্যম। রুনা বললেন, ‘এখন আর সেসব মনে নেই। তবে মঞ্চে যখন গান করি, নিজের অজান্তেই তখন নাচের কিছু মুদ্রা চলে আসে।’

রুনা লায়লা। ছবি: সুমন ইউসুফ
রুনা লায়লা। ছবি: সুমন ইউসুফ

এবার গান
বড় বোন দিনা লায়লা গান শিখতেন। বাসায় তাঁকে গান শেখাতে আসতেন একজন ওস্তাদ। তখন আপনার বয়স কত হবে? ‘এই চার কি পাঁচ।’ বললেন রুনা লায়লা। খেলাধুলা করতেন। দৌড়ঝাঁপ ছিল তাঁর নিত্য কাজ। বোন যখন গান করতেন, তাঁর আশপাশেই থাকতেন। ওস্তাদজি বোনকে যা শেখাচ্ছেন, তা তিনি শুনে শুনেই শিখে নিতেন। পরে গুনগুন করে গাইতেন। রেডিওতে কোনো গান শুনলে সুরটা তাঁর ঠিকই মনে থাকত। মেয়ের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বাবা-মা। গানে মেয়ের সম্ভাবনা সেদিন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা। পরে মেয়েকে গান শেখানো শুরু করেন। রুনা লায়লা বললেন, ‘গানে আমার শিক্ষক ছিলেন আবদুল কাদের, হাবিব উদ্দিন আহমেদ। পরে গজলের গায়কি শিখেছি মেহেদী হাসান সাহেবের বড় ভাই ওস্তাদ গোলাম কাদিরের কাছে।’

প্রথম মঞ্চে
মঞ্চে রুনা লায়লার গান গাওয়ার শুরুটা একদম হঠাৎ করেই। করাচিতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। এখানে গান করবেন দিনা (রুনার বড় বোন)। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিনা। বিপদে পড়েন আয়োজকেরা। শেষে বড় বোনের জায়গায় ছোট বোনকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। রুনা বললেন, ‘ওই অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয়সংগীত করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ছয়। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, আমি নাকি সেদিন ধুমধাম গেয়ে মাত করেছিলাম। তানপুরা নিয়ে গান করেছিলাম। আর ওই তানপুরা ছিল আমার চেয়ে দুই গুণ বড়। সবাই আমার গানে মুগ্ধ হন। খুশি হয়ে সেদিন অনেকেই আমার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।’

আবিদা পারভীন ও আশা ভোসলের সঙ্গে
আবিদা পারভীন ও আশা ভোসলের সঙ্গে

ছবির নাম ‘জুগনু’
তখন রুনা লায়লার বয়স ১২। বললেন, ‘লাহোর থেকে একটি ছবিতে গান করার প্রস্তাব আসে। আব্বা শুনেই না করেন। গান গাওয়া নিয়ে আব্বার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তখন অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। আমার খুব ইচ্ছে হলো। তখন সব বড় বড় শিল্পী রেডিওতে গান করতেন। ভাবতাম, একদিন রেডিওতে আমার নামও বলবে। সবাই আমার গান শুনবে। বাবাকে আমার ইচ্ছের কথা জানান মা। অনেক কষ্ট করে তিনি আব্বাকে রাজি করালেন। আমি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম।’
ছবির নাম জুগনু। উর্দু ছবি। গানটি ছিল ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। পুরো এক মাস চর্চা করেন রুনা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দুই ঘণ্টা আর স্কুল থেকে ফেরার পর দুই ঘণ্টা। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন মনজুর হোসেন। তিনিই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রুনা বললেন, ‘মনজুর হোসেন সাহেব আমাকে ফিল্মে গান গাওয়ার কিছু কৌশল শিখিয়ে দেন। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে কণ্ঠ দিয়েছেন, তিনি তা ঘষে-মেজে পলিশ করেন।’
১৯৬৫ সালের জুন মাসে জুগনু ছবিতে প্রথম গান করেন রুনা। দ্বিতীয় গানটিও একই ছবির। এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলান শর্মিলী আহমেদ।

মো. রফির সঙ্গে রুনা লায়লা
মো. রফির সঙ্গে রুনা লায়লা

প্রথম বাংলা গান
রুনা লায়লা প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং করেন পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। দেবু ভট্টাচার্যের সুর করা গান দুটি ছিল ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ আর ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’।
স্বরলিপি
গত শতকের ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে গান করার জন্য আমন্ত্রণ পান রুনা। চিত্রপরিচালক নজরুল ইসলাম আর সংগীত পরিচালক সুবল দাস স্বরলিপি ছবির গান রেকর্ডিং করতে যান লাহোরে। তাঁরা ছবির একটি গান রুনাকে দিয়ে গাওয়ানোর পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি দারুণ ব্যস্ত। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছয়-সাতটি গান রেকর্ডিং করছেন। কাজ করতেন সকাল ছয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। শুনে রাজি হলেন রুনা। লাহোরের বারী স্টুডিওতে রেকর্ডিং করা হয় গানটি। গানটির শিরোনাম ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। একই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন মাহমুদুননবী। রুনা বললেন, ‘বাংলাদেশে আসার আগে আর কোনো বাংলা ছবিতে গান গাওয়া হয়নি।’

বাংলাদেশে আসার পর প্রথম গান করেন সত্য সাহার সুরে জীবন সাথী ছবিতে।

মান্না দে ও রুনা লায়লা
মান্না দে ও রুনা লায়লা

১৯৭৪ সাল
বাবা-মায়ের সঙ্গে রুনা লায়লা বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। রুনা লায়লা বললেন, ‘সংগীত জগতের অনেকেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সবাই আমাকে স্বাগত জানালেন। আর বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছি, সেটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। আব্বা যখন বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তখন অনেকেই আমাকে পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। শুনিনি। তত দিনে উর্দু ছবিতে আমি অনেকগুেলা গান করে ফেলেছি।’
একই বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে প্রথম ভারত সফর করেন রুনা। ভারতে প্রথম গান করেন দিল্লি বিজ্ঞান ভবনে, এরপর মুম্বাইয়ে শান মুখআনন্দ হলে। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তাঁকে বলা হয় ‘দামাদাম গার্ল’। তাঁর প্লেব্যাক করা প্রথম হিন্দি ছবি এক সে বড়কার এক। কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে তিনি ছবির টাইটেল গানে কণ্ঠ দেন। পর্দায় এই গানের সঙ্গে অভিনয় করেন হেলেন।
গিনেস বুকে রুনা

পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুর করা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা। রুনাকে দিয়ে নানা ধরনের গান করিয়েছেন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক। পরে মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রুনাকে দিয়ে নিসার বাজমির সুর করা গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে। প্রতিদিন একই সুরকারের ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন রুনা। পরে তা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্থান পায় গিনেস বুকে।

১৭টি ভাষায় গান
রুনা বললেন, ‘বাংলা ছাড়া আমি উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানি। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছি।’

সুপার রুনা
১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর। এদিন রুনার গাওয়া বাপ্পী লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে সুপার রুনা অ্যালবাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রথম দিনেই অ্যালবামটির এক লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক। রুনা বললেন, ‘অ্যালবামটির কাজ করেছিলাম লন্ডনে। লন্ডনের এবি রোডেস, যেখানে বিটল্স গান রেকর্ডিং করত।’

রুনা যখন অভিনয়শিল্পী
ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে পাকিস্তান থেকে তো বটেই, ভারত থেকেও অসংখ্য প্রস্তাব পান রুনা লায়লা। কিন্তু তখন তিনি গানকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শেষে একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ছবির নাম শিল্পী। রুনা বলেন, ‘এই ছবিটি আমার জীবনের কিছু গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাই রাজি হয়েছিলাম।’

বাপ্পী লাহিড়ির সঙ্গে রুনা লায়লা
বাপ্পী লাহিড়ির সঙ্গে রুনা লায়লা

একটা পরিবর্তন
শুরু থেকেই টিভি ও মঞ্চে রুনা নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করেন। শার্ট-প্যান্ট কিংবা মেক্সি পরে গান করতেন তিনি। ব্যাপারটি ওই সময় একদম ভাবা যায় না। রুনা বললেন, ‘করাচি টিভিতে আমার একটা অনুষ্ঠান হতো। নাম বাজমে লায়লা। দুই সপ্তাহ পর পর প্রচার হতো। খুব জনপ্রিয় ছিল। আমি তখন তরুণী। যেভাবে থাকতে চাইতাম, সেভাবে টিভিতে আসতাম। শুরুতে অনুষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্যান্ট-শার্ট পরে গান গাওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। অনেকেই ভয়ে ছিলেন। আমি তাঁদের বলেছি, দিস ইজ মাই ইমেজ, দিস ইজ মাই পারসোনালিটি, দিস ইজ মি। আমি এভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চাই। আমি যা না, সেভাবে আসতে চাই না। অনুষ্ঠানটির প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রচুর প্রশংসা পেয়েছি। অনেকেই মন্তব্য করলেন, গান যেন প্রাণ পেল। ১৯৭৪ সালে বিটিভিতে মেক্সি, শাড়ি আর প্যান্ট-শার্ট পরে গান করেছি। সমালোচনা যেমন হয়েছে, প্রশংসাও করেছে। অনেকে আবার নতুন একটা স্টাইল হিসেবে দেখেছে। আমি নেচে-গেয়ে গান করছি, বিষয়টাকে অনেকে স্বাগত জানাল।’

দেশে ফেরার পর জটিলতা
ঢাকায় আসার পর রেডিওতে গান করতে এসে জটিলতার মুখে পড়তে হয় রুনাকে। কর্তৃপক্ষের দাবি, তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য তাঁকে অডিশন দিতে হবে। অডিশন দিয়ে পাস করলে তবেই তিনি রেডিওতে গান গাইতে পারবেন। ব্যাপারটি জানাজানি হওয়ার পর পত্রিকায় রেডিও কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করা হয়। রুনা বললেন, ‘তাঁদের জানিয়ে দিলাম, আমি রেডিওতেই গান করব না। আমি তো চলচ্চিত্রে গান গাই, তাই বিষয়টা নিয়ে মোটেও আর মাথা ঘামাইনি।’

একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করে বিটিভি একটা অনুষ্ঠান তৈরি করে। নাম তোমাদের জন্য। রুনা বললেন, ‘এই অনুষ্ঠানে একই সঙ্গে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী আর বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। অনুষ্ঠানটির শুটিং করেছি পুরাতন বিমানবন্দরে, গানবোটে করে পাগলা ঘাট থেকে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে শুটিং করেছি। বাজেট অল্প হলেও যে ভালোভাবে একটি অনুষ্ঠান করা যায়, এটি ছিল তার একটি প্রমাণ।’

‘ঝলক দিখলা যা’ অনুষ্ঠানে মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে
‘ঝলক দিখলা যা’ অনুষ্ঠানে মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে

বিটিভির অনুষ্ঠানে বড় পরিবর্তন
রুনা লায়লা বললেন, ‘আমি এখনো টিভির পুরো অনুষ্ঠান ছাড়া গান গাওয়ার জন্য রাজি হই না। আমি চাই, আমি যে অনুষ্ঠান করব, তার একটা সুন্দর পরিকল্পনা থাকবে। আর দশটা অনুষ্ঠানের মতো নয়। সবার কাছে যেন অন্যরকম মনে হয়। দর্শক কিন্তু আমার কাছ থেকে অন্যরকম কিছু আশা করে। বিটিভির জন্য এমনিভাবে যে অনুষ্ঠানগুলো করেছিলাম, তা কিন্তু খুবই ভালো হয়েছিল। এখনো দর্শক দেখে আনন্দ পায়।’

বিভিন্ন দেশে গান
আপনি কোন কোন দেশে গান করেছেন? রুনা বললেন, ‘তার আগে আমাকে ভাবতে হবে, কোথায় কোথায় গাওয়া হয়নি। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব জায়গায়ই গান করেছি। এই যেমন রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, ওয়েম্বলি কনফারেন্স সেন্টার, মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন, লিংকন সেন্টার নিউইয়র্ক, সিডনি অপেরা হাউসে অনুষ্ঠান করেছি। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে গান করেছি। আমার অনুষ্ঠানগুলোয় বাংলা, হিন্দি, উর্দু ভাষাভাষির দর্শক বেশি থাকেন। তবে অন্যান্য দেশের দর্শকও থাকেন।’

বিচারক রুনা

১৯৯৯ সালে রুনা লায়লা জি টিভির ‘সারেগামাপা’ (হিন্দি) প্রতিযোগিতায় ছিলেন প্রধান বিচারক। তাঁর সঙ্গে আরও ছিলেন মেহেদি হাসান, গুলাম আলী, ফরিদা খানম ও জগজিৎ সিং। সেবার অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন সনু নিগম। জি বাংলার ‘সারেগামাপা বিশ্বসেরা’ প্রতিযোগিতায় রুনার সঙ্গে বিচারক ছিলেন কুমার শানু ও শান্তনু মৈত্র। বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানের প্রতিযোগীদের নিয়ে ২০১২ সালে দুবাইয়ে আয়োজন করা হয় ‘সুরক্ষেত্র’। রুনা লায়লা ছাড়াও এখানে আরও ছিলেন আশা ভোঁসলে ও আবিদা পারভীন। বাংলাদেশে চ্যানেল আইয়ের ‘সেরাকণ্ঠ’ এবং চ্যানেল নাইনের ‘পাওয়ার ভয়েস’ প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন তিনি।

চ্যানেল আইয়ে ‘সেরা কণ্ঠ’ অনুষ্ঠানে সাবিনা ইয়াসমীন ও ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে
চ্যানেল আইয়ে ‘সেরা কণ্ঠ’ অনুষ্ঠানে সাবিনা ইয়াসমীন ও ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে

নতুনদের মধ্যে সম্ভাবনা
নতুনদের মধ্যে সম্ভাবনার আলো দেখতে পান রুনা। তবে মাঝেমধ্যে তাঁর মধ্যে হতাশাও কাজ করে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নতুনদের কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। বললেন, ‘আমাদের এখানে মেধার অভাব নাই। কিন্তু তাদের মধ্যে শেখার আগ্রহের খুব অভাব। আবার যাদের আগ্রহ আছে, তারা সুযোগ পাচ্ছে না। প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে না। আমরা অনেক কষ্ট করে অনেক সাধনার পর কিছু পেয়েছি। এখন সবকিছু দ্রুত পাওয়া যায়। সবাই রাতারাতি তারকা হয়ে যাচ্ছে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পেয়ে যাচ্ছে। গাড়ি-বাড়ি হচ্ছে। নিজেকে সমৃদ্ধ করার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে এক নতুন ছেলের সঙ্গে গান করেছি, নামটা কিন্তু বলব না। বারবারই ও ভুল করছিল। সুর হচ্ছিল না। মিউজিক ডিরেক্টর বারবারই ঠিক করতে বলছিলেন। কিন্তু ছেলেটি বলল, “আমি এভাবেই গাইব, নিলে নেন, না হলে আমি চলে যাই।” আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমরা এখনো এমন কথা ভাবতে পারি না।’

পছন্দের সুরকার ও সংগীত পরিচালক
রুনা বললেন, ‘পাকিস্তানের নিসার বাজমি, তিনি তাঁর বেশির ভাগ ছবিতে আমাকে দিয়ে গাইয়েছেন। একটা ছবিতে ছয়টা গান থাকলে পাঁচটা গানই আমাকে দিয়ে গাওয়াতেন। ক্লাব সং, স্যাড সং, ক্লাসিক্যাল, গজল, গীত—সব ধরনের গান তিনি আমাকে দিয়ে করিয়েছেন। আমার কণ্ঠকে সঠিকভাবে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে আলাউদ্দীন আলী, সুবল দাস, আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আনোয়ার পারভেজ। নতুনদের মধ্যে ইমন সাহা, শওকত আলী ইমন, বাপ্পা মজুমদার। ভারতে কল্যাণজি-আনন্দজি, লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল, বাপ্পী লাহিড়ী।

পছন্দের সহশিল্পী
রুনা জানালেন, পাকিস্তানে তাঁর পছন্দের সহশিল্পী আহমেদ রুশদি, মেহেদি হাসান, মালা বেগম। বাংলাদেশে খুরশীদ আলম, এন্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী। ভারতে তাঁর বেশির ভাগই একক গান। তবে কুমার সানুর সঙ্গেও অ্যালবাম করেছেন।

বড় অর্জন
রুনা বললেন, ‘মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। একেক সময় আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। এটা সত্যিই অকল্পনীয়। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো আমাদের গানের দেবী-দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে হঠাৎ দেখি কেউ এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। এটা সত্যি বিরাট পাওয়া।’

আর্তের সেবায়
গানের পাশাপাশি শুরু থেকেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন রুনা। বাড়িয়েছেন সহযোগিতার হাত। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়তার জন্য সুইড বাংলাদেশের হয়ে কাজ করছেন। সার্কের শুভেচ্ছাদূত তিনি। ইউএনএইডসের শুভেচ্ছাদূত হয়ে এইচআইভি/এইডসের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করছেন। বড় বোন দিনার মৃত্যুর পর ঢাকায় শিশু হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ওয়ার্ড গড়েছেন। এখন স্বপ্ন দেখেন ক্যানসার হাসপাতাল গড়ার।

ডিজাইনার রুনা
রুনা লায়লা কিন্তু নিজের পোশাকের নকশা নিজেই করেন। তাঁর নিজস্ব নকশা করা পোশাকের একটা সংগ্রহ ছিল। তা নিয়ে সামনে আরও বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা আছে তাঁর।

শেষ কথা
রুনা বললেন, ‘যত দিন ভালো গাইতে পারব, তত দিন গান গাইব। নিজে মনে করব যে এখনো গাইতে পারছি, সুর নড়ছে না, বেসুরো হচ্ছে না, কণ্ঠ কাঁপছে না, তত দিন গান করব। যখন মনে হবে এখন আর হচ্ছে না, তখন গান ছেড়ে দেব। আর আমার একটাই কথা বলার আছে, সবাই যদি আমরা দেশকে ভালোবাসি, আমি শব্দটা বাদ দিয়ে আমরা যদি বলি, সবাই মিলে যদি দেশটাকে ভালো করতে চাই, উন্নতির দিয়ে এগিয়ে নিতে চাই, তাহলেই আমরা পারব।’

এ আয়োজনের ছবিগুলো রুনা লায়লার ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে নেওয়া
এ আয়োজনের ছবিগুলো রুনা লায়লার ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে নেওয়া