
শেষবার তিনি ঢাকায় এসেছিলেন চলতি বছরের মার্চে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজিত ছায়ানটের ‘দেশঘরের গান’ উৎসবের উদ্বোধক ছিলেন তিনি। দুই দিন ঢাকায় ছিলেন। গান শুনিয়েছেন, মনের কথা বলেছেন। যে রাতে ফিরে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রামে নিজের ঘরে, তার আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ। হাতিরপুলে লেজার ভিশনের অফিসে। রাতের বাসে ফিরবেন। তাড়া ছিল। তার আগে কিছুক্ষণ আড্ডা।
যাওয়ার আগে বিদায়বেলায় সবার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বলছিলেন, ‘এবারই শেষ। আর ঢাকায় আসা হবে না। ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েন।’ ‘এভাবে বলছেন কেন?’ প্রশ্নটা শেষ হওয়া মাত্রই দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘এটাই তো নিয়ম। চলে যেতে হবে...।’
কী আশ্চর্য! এভাবে তিনি নিজের কথা রাখবেন ভাবিনি একটি বারের জন্য। ২১ ডিসেম্বর শেষবারের মতো নিশ্বাস নিলেন ছাড়লেন পৃথিবীর বাতাসে। ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার নিজ বাড়ি পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামে সবুজ মাটির বিছানায় চিরদিনের জন্য শায়িত হন। রশিদাবাদ গ্রামে নিজের বাড়িতেই শেষ সময়টা কাটে তাঁর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়মিত লিখেছেন তিনি। রশিদাবাদ গ্রামে আবদুল গফুর হালীর জন্ম ১৯২৯ সালে। বাবা আবদুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ আরেক সাধকশিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের গ্রাম। আস্কর আলীর গান শুনে বড় হয়েছেন গফুর।
তাঁকে যতবার দেখেছি, কড়া নেড়েছিল শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি। হাটে ঘাটে মাঠে ময়দানে তাঁর কত গান বেজেছিল। ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা’, ‘পাঞ্জাবিঅলা মনে বড় জ্বালারে, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুল গো’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই’, ‘অ শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইও, বানুরে অ বানু’, ‘বইনদ্দি নওশিরো, নিশিরও কালে’ কিংবা মাইজভান্ডারি গান ‘দেখে যারে মাইজভান্ডারে হইতাছে নুরের খেলা’, ‘কত খেলা জানোরে মাওলা’, ‘মাইজভান্ডারে কী ধন আছে’ এবং ‘মোহছেন আউলিয়ার গান—চল যাই জিয়ারতে মোহছেন আউলিয়ার দরবারে’, ‘আল্লাহর ফকির মরে যদি’ এ রকম আড়াই হাজার গানের স্রষ্টা আবদুল গরুর হালী।
বড় অন্যায় করা হয়েছিল এই কিংবদন্তির সঙ্গে। বেশির ভাগ সময় যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। তাঁর গান গেয়ে কত শিল্পী তারকা হয়েছেন, দেশ-বিদেশে নাম করেছেন, উপার্জন করেছেন—অথচ সারাটা জীবন দারিদ্র্যের ছায়ায় ছিল তাঁর বসবাস। শেষ দিনগুলোতে চিকিৎসার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছিল। অবশ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান তাঁকে ও তাঁর কাজকে পাত্তা না দিলেও দেশের বাইরে প্রচুর কাজ হয়েছে গফুর হালীর কাজ নিয়ে। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গান নিয়ে গবেষণাকর্ম করছেন একদল লোকগবেষক। জার্মান ভাষায় তাঁকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র। ২০০৪ সালে হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হান্স হার্ডার গফুর হালীর ৭৬টি গান জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ‘ডর ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ বা ‘পাগলা গফুর বলে’ শিরোনামে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
হান্স হার্ডার মনে করেন, বাংলার লোকসংগীতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বিশেষভাবে অধিষ্ঠিত করেছেন গফুর হালী। এসব গান কালের সীমা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এবং বেশ আদৃত হচ্ছে। আবদুল গফুর হালী প্রথম মোহছেন আউলিয়াকে নিয়ে গান রচনা করেন। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রথম লোকনাটকের রচয়িতাও গফুর হালী। হার্ডার আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজেকে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে সরাসরি ধাবিত করেননি, সুর ও আধ্যাত্মবাদে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।’
‘গাইতে গাইতে আমি শিল্পী’ কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গফুর হালী বলেছিলেন, ‘উঠানে বসে গান হতো। আমাদের দেশে (চট্টগ্রামে) এটাকে নাট্যপুয়ার গান বলে। মানে এ রকম আসর প্রায়ই হইত। আমি গানের পোকা ছিলাম...আর বিশেষ করে, সিনেমার পোকা বেশি ছিলাম।...তখনকার সিনেমা খুব মিষ্টি একটা জিনিস ছিল। তখন আমি এই সিনেমার গান শুনে শুনে হুবহু করে করে গাইতাম। গাইতে গাইতে...আমি শিল্পী হয়ে গেলাম।’