দোস্ত - আই মিস ইউ

দিতি আমার বন্ধু, ১৯৯৮ সাল থেকে আজ অবধি দিতির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব একই গতিতে চলছে। তিনি আমার শুধু বন্ধু, এটা বললে অল্প বলা হয়। দিতি ও আমি যেন দুই বোন, এক আত্মিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি আমার সুখ-দুঃখের সাথি। এই ১৮ বছরে দিতির পরিবার ও আমার পরিবারের মধ্যে রয়েছে কত সুখ-আনন্দের স্মৃতি। আবার শামিল হয়েছি পারস্পরিক সমস্যা ও সংকটে। আমি শুধু ফোন করে বলতাম, দোস্ত, আমার এই ঝামেলা কিংবা সমস্যা। তিনি সব সময় আমাকে বলতেন, ‘নো প্রবলেম, আমি দেখছি।’ সারাটা জীবনে সবার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা এবং সবার পেরেশানিকে নিজের ঘাড়ে তুলে নেওয়া যাঁর স্বভাব ছিল, তাঁর আজ চরম সংকটময় সময়ে আমি এবং আমার মতো তাঁর কাছের আরও মানুষ কী করতে পারছি? ভাবতেই সারা মন ব্যথায় ভরে ওঠে। দোস্ত...আপনি ভালো হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুন...। এই কথাটা চিৎকার করে বললেও কি আমার দোস্তের কান পর্যন্ত পৌঁছাবে? কেবলই চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারি না।
দিতি নিজে ভালো মানুষ ছিলেন এবং নিজের জীবনকেও ভালোবাসতেন। বছর সাতেক আগে আমরা দুই বন্ধু গিয়েছিলাম মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে। বেড়ানোর পাশাপাশি মেঘের কোলে রোদ চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখা ও অনুমতি নেওয়া ছিল কাজ। সারা দিন ওখানকার মন্ত্রণালয়ে কাজ করতাম আর সন্ধ্যায় দুই বন্ধু মিলে শপিং ও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ডিনার করতাম। একদিন ম্যাকডোনালসে খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, দোস্ত পুরো খাবারগুলো তৃপ্তিসহকারে খেয়ে নিচ্ছেন আর আমি তো বরাবরই খামখেয়ালি। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বলছিলাম, দোস্ত, পয়সা উশুল। উনি তখন বললেন, ‘নিজেরটা শেষ করেন। এই খাবারের জন্যই আমি আজ দিতি হয়েছি।’ এটা ছিল আমার জন্য বিরাট একটা শিক্ষা। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমি প্লেটে কোনো খাবার ঝুটা করি না, এমনকি নষ্টও করি না। আমার মনে হচ্ছে জীবনে চলার পথে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো আর কে বলবে। দোস্ত—আই মিস ইউ...।
আর একবার পাতালপুরির গল্প টেলিছবির জন্য কলকাতায় প্রদর্শন ও পুরস্কার গ্রহণের আমন্ত্রণ এল। আমার সফরসঙ্গী শুভ্র দেব, কবির বকুল এবং আমার দোস্ত দিতি। বিমান যখন টেক অফ করল, তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেকি ঘূর্ণিঝড়। বিমান ঘুরপাক খেতে লাগল। দিতি তসবি বের করে দোয়া পড়ছেন আর এক হাত দিয়ে আমার কবজি চেপে ধরলেন। একটু পরপর চিৎকার করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার বাচ্চারা...।’ বকুল আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখে ইশারা দিলাম চুপ থাকতে। অবশেষে ৩৫ মিনিটের জার্নি ৫৫ মিনিটে গিয়ে কলকাতায় পৌঁছাল। আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সাপ পেঁচিয়ে থাকলে যেমন দাগ হয়ে যায়, ঠিক তেমনভাবে দাগ হয়ে গেছে। উনি কতটা জোরে হাতটা চেপে ধরেছিলেন। দোস্ত এখন কি চেন্নাইয়ের হাসপাতালে শুয়ে আপনি আপনার বাচ্চাদের জন্য ব্যাকুল হচ্ছেন? তাকিয়ে দেখছেন লামিয়া আর দীপ্ত আপনার দুই নয়নের মণি আপনার পাশে রয়েছে। আপনার সুস্থতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও সেবা করে যাচ্ছে। দোস্ত, আমি কি এই জনমে আপনার মতো কোনো বন্ধু পাব? আপনি কি শোনেন আমি ও আমার পরিবার আপনার সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করছি। আপনি জলদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। সামনে আপনার আরেক ছেলে জয়ের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। আপনি ছাড়া এই অনুষ্ঠানের পূর্ণতা কী করে হবে?
গত কোরবানির ঈদের দিন রাতের ডিনার করেছি দিতির বাসায় তাঁর সঙ্গে। তখন তিনি প্রথম দফার অপারেশন শেষ করে এসেছেন। আমি মুখোমুখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন, ‘চোখের পানি মোছেন। কেন ইমোশনাল হচ্ছেন, আমি তো ভালো হয়ে গেছি।’ আমি জানতাম না যে আমার দুই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কাছে গিয়ে বসলাম। কত কথা, হাসিঠাট্টা। এরই মধ্যে এল অরুণা বিশ্বাস। আড্ডা আরও জমে গেল। অরুণা যখন বলল, আমার যৈবতী কন্যার মন ছবিতে সে একটা দারুণ চরিত্রে অভিনয় করছে। শুনে দিতি অভিমান করে বললেন, ‘ওকে নিলেন কেন, আমি আরেকটু সুস্থ হয়ে আমিই করতাম।’
কিসে একটা আশার আলো আমি দেখতে পেলাম। বললাম, আপনি সুস্থ হন; আপনাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে এর পরের চলচ্চিত্র বানাব। উনি হেসে বললেন, ‘তেমন কাজ না করলেও আমার দোস্তের কাজ আমি করব।’
আমি আর লিখতে পারছি না...
আমি আমার দোস্ত দিতির সব শুভাকাঙ্ক্ষী, ভক্ত এবং কাছের মানুষকে বলতে চাই, আসুন, আমরা সবাই তাঁর জন্য প্রার্থনা করি।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা