নাগরিক কোলাহলে শিরোনামহীন

বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। ‘একা পাখি’, ‘ক্যাফেটেরিয়া’, ‘বন্ধ জানালা’ গানগুলোই যাঁদের পরিচয়, তাঁদের নামে কী আসে যায়? তাঁরা শিরোনামহীন! ২১ জুলাই আমাদের আমন্ত্রণে প্রথম আলো কার্যালয়ে হাজির শিরোনামহীনের পাঁচ চেনা মুখ। গিটারিস্ট দিয়াত খান, কি-বোর্ডিস্ট রাসেল কবির, ড্রামার কাজী শাফিন আহমেদ আর বেইজিস্ট জিয়াউর রহমান—চারজনের গায়েই নিজেদের ব্যান্ডের টি-শার্ট। ব্যতিক্রম ভোকালিস্ট তান্যীর তুহীন। ‘ইউনিফর্মে’ ভিন্নতার কারণ দর্শালেন তিনি, ‘আমার টি-শার্ট একদম টাটকা! ব্যাগেই আছে। এক ফাঁকে চট করে পরে ফেলব।’ খবরটা ইতিমধ্যে সবার জানা। এসে গেছে শিরোনামহীনের নতুন অ্যালবাম, শিরোনামহীন। এই হলো খবরের সারাংশ। তবে অ্যালবামের নতুনত্ব আর ভিন্নতার পুরোটা জানতে হলে আপনাকে একটা লম্বা দম নিতে হবে। কালেকটরস এডিশন, ইকোনমি এডিশন, অনলাইন পদ্ধতি, টি-শার্ট, মগ, গিটার পিক...এত সব এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলার কোনো উপায় নেই। ‘কালেকটরস এডিশন’ থেকেই শুরু করা যাক। বেইজিস্ট জিয়া ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে, ‘এখন মানুষের মধ্যে সিডি কিনে গান শোনার প্রবণতা কম। কালেকটরস এডিশন হলো সংগ্রাহকদের জন্য, যাঁরা সিডিটা সংগ্রহে রাখতে চান।’ কালো মোড়ক আর অদ্ভুত সুন্দর ডিজাইন, সংগ্রাহকদের জন্য তৈরি শিরোনামহীন অ্যালবামের মলাটও তুলানাহীন। হাতে নিলে প্রথম দর্শনে আপনার মনে হবে কোনো কবিতার বই। পাতা ওল্টালেই গানের লিরিক, লিরিকের পেছনের ভাবনা। যাঁরা অনলাইনে স্বল্পমূল্যে গানগুলো ডাউনলোড করতে চান, তাঁদের জন্য আছে ‘ইকোনমি এডিশন’। শিরোনামহীনের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই অনলাইনে ক্রয়ের বিস্তারিত জানা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কাইনেটিক মিউজিকের সঙ্গেও ব্যান্ডটির চুক্তি হয়েছে। গানগুলো যেন পাইরেসি না হয়, সে নিশ্চয়তা তারা দেবে। অ্যালবামের পাশাপাশি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ব্যান্ডের সদস্যদের অটোগ্রাফ কিংবা ছবি-সংবলিত টি-শার্ট, মগ, গিটার পিক আর লিরিকস প্যাড।
এই যে এত আয়োজন—কেন? জিয়া বললেন, ‘বাইরের বিশ্বে এসব কিন্তু নতুন নয়। আমাদের দেশের শ্রোতাদের একটা নতুন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এত কিছু।’ টি-শার্ট, মগ, গিটার পিক সম্পর্কে তুহীনের বক্তব্য, ‘এসবের অর্থ হলো শ্রোতাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি করা। কেউ যখন আমাদের নাম লেখা মগে এক কাপ চা খাবে, কিংবা আমাদের ছবি আঁকা পিক দিয়ে গিটার বাজাবে, তাঁরা আমাদের কথা মনে করুক।’
তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তরটা এর আগেই কথাচ্ছলে জিয়া দিয়েছেন। বলছিলেন, ‘আমাদের অ্যালবামের কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই। শ্রোতারাই আমাদের পৃষ্ঠপোষক।’ তাই তো! একজন শ্রোতা যখন শিরোনামহীনের টি-শার্ট পরবেন, তিনি হবেন ব্যান্ডটির নতুন অ্যালবামের চলমান বিজ্ঞাপন।
অ্যালবামের কোন গানটা নিয়ে বাজি ধরা যায়? দিয়াতের উত্তর, ‘অবশ্যই “আবার হাসিমুখ!” “হাসিমুখ” গানটা তো আগে থেকেই জনপ্রিয়।
“আবার হাসিমুখ” নিয়ে তাই সবাই বেশ রোমাঞ্চিত।’ তুহীনের ভোট অবশ্য ‘শন্শন্, যদিও কাশবন’ গানটির প্রতি। অ্যালবামের অধিকাংশ গান জিয়ার লেখা। আড্ডার এক ফাঁকে প্রশ্ন তাঁর কাছে, আপনার গানে ঘুরেফিরে নগর-রাজপথ-জানালার দেখা মেলে, একটা শহুরে প্রভাব কি আছে? জিয়া বললেন, ‘ধুলাবালি-যানজট, তবু শহরটাই আসলে ভালো লাগে। তা ছাড়া শহরেই থাকি। আমি তেমন কল্পনা করতে পারি না। মাথায় যা আসে লিখে ফেলি।’
কথায় কথায় ঘুরেফিরে বারবার এল অডিওশিল্পের দুরবস্থার কথা। জিয়া, তুহীনেরা মুখ কালো করে সেসব কথা বললেও ‘আবার হাসিমুখ’ দেখা গেল ভক্ত-শ্রোতাদের কথা বলতে গিয়ে। কি-বোর্ডিস্ট রাসেল বলছিলেন, ‘একসময় প্রতি শুক্রবার এখানে-ওখানে কনসার্ট হতো। ধানমন্ডি, বনানীর রাস্তাগুলো পোস্টারে ছেয়ে যেত। উঠতি ব্যান্ডগুলো নিজেরাই চাঁদা তুলে কনসার্ট আয়োজন করত। এখন আর দেখি না। খরচটা আসলে কুলানো যায় না। কোম্পানিগুলো কনসার্টের পৃষ্ঠপোষকতায় এখন তেমন আগ্রহী নয়। আমরা বেঁচে আছি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কারণে। তাঁরাই অধিকাংশ শো আয়োজন করে।’ জিয়া সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আর্থিকভাবে শিল্পীরা আসলে খুব ভালো নেই। এ কারণে, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিভাগুলোও হারাচ্ছি।’ শিরোনামহীনদেরও আছে ভিন্ন পরিচয়। কেউ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আর্কিটেক্ট, কেউ এমবিএ করেছেন। ভোকালিস্ট তুহীনকে তো আজকাল নাটকেও দেখা যাচ্ছে! স্পুক নাটকে তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা শুনে হাসলেন। সঙ্গে তথ্য দিলেন, ‘এবার ঈদে আশুতোষ সুজনের পরিচালনায় তারিনের সঙ্গে একটা নাটক করলাম।’
গল্পে গল্পে ততক্ষণে ছবি তোলা পর্ব শেষ। বিদায় নিয়ে শিরোনামহীনরা মিশে যান ‘নাগরিক কোলাহলে’...।